ঢাকা ০১:৫৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

ঈদুল আযহার তাৎপর্য

  • আপডেট সময় : ১০:২৬:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৪
  • / ২৪৫৯ বার পড়া হয়েছে
Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

ঈদুল আযহার তাৎপর্যঃ

“ঈদুল আয্হা” অর্থ কোরবানীর উৎসব। ইহা ঈদুল কুরবা বা ঈদুন নাহ’র নামেও অভিহিত। কোরবানী কি? মহান খোদাতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে পশু জবাই করাই কোরবানী। ‘আযহা’-র মূলে আছে ‘‘উয্‌হিয়া শব্দ”-যাহার অর্থ উৎসর্গিত পশু অর্থাৎ যে সব পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয়। কোরবানী অনুষ্ঠিত হয় ১০-ই যিলহজ্ব-যেইদিন মিনা উপত্যকায় হাজ্জীগণ কুরবানী করেন এবং তৎপরবর্তী দুইদিনে, মতান্তরে তিন দিনে।
কোরবানীর উৎসব উদ্‌যাপনের মূলে আছে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানীর আদর্শ স্মরণ ও অনুসরণ। আজ হইতে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের কথা। স্বপেè প্রত্যাদৃষ্ট হইয়া আল্লাহর বন্ধু হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আঃ) এই দিনে মিনা প্রান্তরে নিজ প্রাণাধিক পুত্রের গলায় ছুরি চালাইয়াছিলেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ১৬৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। ৮৫ বৎসর পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালার নিকট তিনি সন্তানের জন্য দু’আ করেন। আল্লাহ তাঁহার দু’আ কবুল করেন। তিনি একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্র সন্তান লাভ করেন। পুত্রের নাম রাখেন ইসমাইল। ইসমাইল (আঃ) ধীরে ধীরে বড় হইতে থাকেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর দেলে পুত্রের মহব্বত পয়দা হয়। পুত্র যেন তাহার দেলের কিংদাংশ দখল করিয়া নেয়। কিন্তু আল্লাহ প্রেমিকতো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহাকেও ভালবাসিতে পারেন না। যদি কখনও আল্লাহ ছাড়া অন্যের প্রতি কিঞ্চিৎ মহব্বতও দেলে পয়দা হয়, তবুও আল্লাহ তাহাকে ছাড়েন না। হযরত ইব্রাহিমের দেলে পুত্র ইসমাইল আসন পাতিয়াছে। ইব্রাহিম (আঃ) তদীয় পুত্রকে নিজ প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসেন। আল্লাহ পাক তাই চান ইব্রাহিমকে (আঃ) পরীক্ষা করার। একদা নিশিতে স্বপèযোগে তাহাকে আদেশ দেওয়া হয়, ‘‘হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইলকে স্বহস্তে জবেহ কর।”

পুত্রের মহব্বত দেলে পয়দা হইলেও তিনিতো ছিলেন আল্লাহ-প্রেমিক; আল্লাহর পূর্ণ অনুগত ও সমর্পিত বান্দা। তাই আল্লাহর নির্দেশে তাঁহার মধ্যে না কোন ভয় দেখা গেল; না কোন উৎকন্ঠার সৃষ্টি হইল। তিনি পুত্রকে কোরবানী করিতে সিদ্ধান্ত লইলেন এবং পুত্রকেও আল্লাহর নিকট হইতে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশ সম্পর্কে অবহিত করিলেন। পুত্রও নিবেদিত প্রাণ। খোদার রাস্তায় কোরবানীর কথা শুনিয়া তাহার দেলে খোদাপ্রেম যেন উথলিয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করার সম্মতি ব্যক্ত করিলেন। পিতা-পুত্র খোদা প্রেমের অগ্নি পরীক্ষার অবতীর্ণ হইলেন। পাক কালামে এই অপূর্ব ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপে সন্নিবেশিত হইয়াছে।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন বলিলেন, ‘‘হে আমার প্রাণাধিক পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করিতেছি, এই সম্পর্কে তোমার কি অভিমত? কিশোর ইসমাইল জবাব দিলেন, হে আমার পিতা! আল্লাহর আদেশ আপনি বিনা দ্বিধায় পালন করুন। আমাকে ইন্‌শাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাইবেন।”

আল্লাহর খলিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) অতঃপর নিজ পুত্র ইসমাইলকে লইয়া মিনা উপত্যকায় যাইয়া তথায় পুত্রকে মাটিতে শোয়াইলেন, অতঃপর পুত্রের কোমল কন্ঠনালীতে ধারালো ছুরি চালনা করিতে লাগিলেন। প্রেমাস্পদ মাশুকের জন্য প্রেমিকের এমন অপূর্ব নজরানা প্রদানের দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে কেহ দেখিয়াছে কি? আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানী কবুল করিলেন এবং পুত্রকেও ফেরত দিলেন। পুত্রের স্থলে কোরবানীর জন্য একটি বেহেশতী দুম্বা পাঠাইয়া দিলেন।

পাক কালামে প্রকাশঃ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘অতঃপর যখন হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল আল্লাহতায়ালার নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন এবং ইব্রাহিম ইসমাইলকে জবেহ করার জন্য অবনত মস্তকে মাটিতে শোয়াইলেন, তখন আমি আহবান করিলাম, হে ইব্রাহিম! তুমি অবশ্যই তোমার স্বপেèর সত্যতা প্রমাণ করিয়াছ; নিশ্চয়ই আমি এই ভাবেই নেককার লোকদের প্রতিফল দিয়া থাকি। নিশ্চয় ইহা স্পষ্ট মহান পরীক্ষা। ইসমাইলের কোরবানী স্থলে আমি এক মহান কোরবানী দান করিয়াছি। অনাগত ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে আগমনকারীদের জন্য এই ঘটনাকে স্মরণ করার বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছি। অতএব শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহিমের উপর।”

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) প্রেম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। আল্লাহপাক তাঁহাকে খলিল উপাধিতে ভূষিত করিলেন। প্রেমাস্পদের নির্দেশে নিজ হাতে পুত্র কোরবানীর যে অপূর্ব ও অনুপম দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করিলেন- সেই অপূর্ব কর্মকান্ড, ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্যে আল্লাহতায়ালা এক চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বংশধর আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) কে কোরবানীর আদেশ দিলেন এবং তদসংগে উম্মতে মুহাম্মদীকে কোরবানীর উৎসব পালনের নির্দেশ দিলেন। আল্লাহতায়ালা রাসূলে পাক (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন,

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (108:1) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (108:2)
অর্থাৎ-‘‘আমি আপনাকে বহু কল্যাণ দান করিয়াছি। অতএব আপনি নামাজ পড়ুন এবং কোরবানী করুন।” (সূরা কাওছার)
উম্মতে মুহাম্মদীর উপর কোরবানী করার নির্দেশ আসিয়াছে। উম্মতে মুহাম্মদী ছাড়াও অন্যান্য উম্মতের উপর ইহা প্রবর্তিত হইয়াছিল। আল্লাহপাক বলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ (22:34)
অর্থাৎ-‘‘এবং আমি নির্ধারণ করিয়াছি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানীর নিয়ম যাহাতে তাহারা আল্লাহর (আমার) নাম স্মরণ করে গৃহপালিত চতুস্পদ পশুর উপর।” (সূরা হজ্জঃ ৩৪)

পাক কালামে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘‘এবং তুমি ঘোষণা করিয়া দাও (হে ইব্রাহিম!) মানুষের মধ্যে হজ্জের। তাহারা আসিবে তোমার নিকট পায়ে হাঁটিয়া এবং উটে চড়িয়া-যাহা আসিবে দূর দূরান্ত হইতে-যাহাতে তাহারা শামিল হয় তাহাদের লাভের ব্যাপারসমূহে এবং স্মরণ করে আল্লাহর নাম গৃহপালিত চতুস্পদ পশুর উপরে (অর্থাৎ কোরবানী করে উহাদিগকে) যাহা তাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা দান করিতেছেন-কতক নির্দিষ্ট দিনে। অতঃপর (হে হাজ্জীগণ!) তোমরা নিজেরাও খাও ইহা হইতে এবং অভাবীকেও দাও।” (সূরা হজ্জঃ ২৭-২৮)
কোরবানী করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দয়াল নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘হে লোকসকল! (জানিয়া রাখ,) প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানী করা আবশ্যক।” (আবু দাউদ) কোরবানী মিল্লাতে ইব্রাহিম। প্রতি বৎসর যিলহজ্জ মাসের নির্ধারিত দিনে পশু কোরবানী দেওয়া প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির জন্য ওয়াজেব (মতান্তরে সুন্নতে মোয়াক্কাদা)।

 

কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যঃ

পশু কোরবানী দেওয়া কোরবানীর জাগতিক নিদর্শন। কোরবানীর একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানীতে মূল এবং প্রতিবিম্ব-উভয়ই ছিল। কোরবানীর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য মূল এবং পশুর গলায় ছুরি চালনা -যাহা কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের যেল বা ছায়া।

পূর্বেই বলা হইয়াছে-ইব্রাহিম (আঃ) এর দেলে পুত্রের প্রতি অনুরাগ ছিল, আসক্তি ছিল। এই পুত্র প্রেম বা পুত্রস্নেহ গায়ের আল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। প্রেমের ময়দানে গায়ের আল্লাহর কোন স্থান নাই। আল্লাহ ব্যতীত অপরাপর সবকিছুর মহব্বত দেল হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে হয়; নতুবা আল্লাহ প্রেম দেলে পয়দা হয় না; ইসলামের হকিকতের সুবাসও পাওয়া যায় না। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুত্রের গলায় ছুরি চালাইলেন -যাহার অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল এই যে, তদীয় দেলে যে পুত্রপ্রেম বাসা বাঁধিয়াছিল, তিনি তাহা ঝাড়িয়া ফেলিলেন, গায়ের আল্লাহর মহব্বত পরিত্যাগ করিলেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী ছিলেন। পাক কালামে প্রকাশঃ
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ (2:131)
অর্থাৎ-“যখন তাহার প্রতিপালক বলিলেন, [হে ইব্রাহিম!] আত্মসমর্পণ কর।” (সূরা বাকারাহঃ ১৩১) তিনি উত্তর করিলেন,
أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (2:131)
অর্থাৎ-‘‘বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে আমি নিজেকে সমর্পণ করিলাম।” (সূরা বাকারাহঃ ১৩১)

যিনি নিজেকে সমর্পণ করিয়াছেন-তাহার নিজস্ব বলিয়াতো কিছু থাকার কথা নয়। তাহার কামনা বাসনা, ইচ্ছা-আকাংখা, প্রেম-ভালবাসা, জীবন-মরণ সবইতো আল্লাহর। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাহার ত্যাগ ও উৎসর্গের মাধ্যমে তদীয় আনুগত্য ও আত্মসমর্পণেরই পূর্ণ পরিচয় দিলেন। আদৃষ্ট হওয়া মাত্রই পুত্রের কন্ঠনালীতে ছুরি চালনা করিলেন। এই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণই ইসলাম-যাহার পূর্ণ বিকাশ ছিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইলের (আঃ) জীবনে। এখানে ‘ইসলাম’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

ইসলাম কি?

ইসলাম মূল ‘‘সালাম” ধাতু হইতে উৎপন্ন। ইহার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ শান্তি, বিরোধ পরিহার বা আপোষ এবং পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একটি অর্থের সাথে আরেকটি অর্থের গভীর সম্পর্ক বর্তমান। এই সম্পর্ক বুঝার জন্য কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন। আমাদের এই দেহ চারটি জড় পদার্থ-আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সমন¦য়ে গঠিত। উল্লিখিত চতুর্বিধ জড় উপাদানে তৈরী মানবদেহে আরও এক সত্ত্বার আবির্ভাব ঘটিয়াছে-যাহার নাম নাফসে আম্মারা। জড় উপাদানে তৈরী বিধায় নাফসে আম্মারা যাবতীয় জড় বা অন্ধকার বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। যাবতীয় কুচিন্তা ও কুকর্ম নাফস হইতে উৎপত্তি। নাফসের জাত-স্বভাব আল্লাহর সাথে বিরোধ করা, ঝগড়া করা এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের তোয়াক্কা না করা।
যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে নাফসের উপরে উল্লিখিত বিরোধ বিরাজমান থাকিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্য ইসলামের তথা শান্তির ঠিকানা পাওয়া সম্ভব নয়। তরিকতের বিধানমত তথা ওলীয়ে কামেলগণের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী সাধনা করিলে ধীরে ধীরে নাফসের আল্লাহ বিরোধী স্বভাব বা অন্ধকার দোষসমূহ দূর হয়। নাফস এত্‌মিনানে আসে, নিজ ভুল বুঝিতে পারে এবং খোদার উপর সন্তুষ্ট হয়। খোদাতায়ালাও তাহার উপর সন্তুষ্ট হয়। ফলে ইসলাম অর্থ বিরোধ পরিহার বা আপোষ-এই আপোষের নিগুঢ় তাৎপর্য সে বুঝিতে পারে।

 

খোদার সাথে নাফসের আপোষ হয়। নাফস তাহার যাবতীয় কু-দোষসমূহ দূর করিয়া নিজ ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছায় বিলীন করে। সে নিজেকে পূর্ণভাবে খোদার হস্তে ন্যস্ত করে। ইহাই পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রথমে বিরোধ নিস্পত্তি; তৎপর আত্মসমর্পণ এবং খোদার পূর্ণ আনুগত্য। এই অবস্থাতে খোদাতায়ালা ঐ সাধকের উপর খুশী হন এবং তাহার উপর অবিরাম প্রেমের নূর বর্ষণ করিতে থাকেন। ফলে সে ব্যক্তি খোদার প্রেমে এমনই বিভোর হন যে, দুনিয়ার কোন দিকেই তাহার লক্ষ্য থাকে না; কোন কিছুর প্রতিই মহব্বত থাকে না। সে খোদার শান্তিময় প্রেমসমুদ্রে অবিরাম সাঁতার কাটিতে থাকে। ইসলাম অর্থ শান্তি-ইহার মর্মার্থ উল্লিখিত স্তরের প্রেমিক সাধকেরাই উপলব্ধি করিতে পারেন। ইসলামের হকিকতও ঐ স্তরেই নিহিত।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর নাফস জন্মগত পবিত্র ছিল। তদীয় নাফসের সাথে আল্লাহর কোন বিরোধ ছিল না। তাই তিনি ছিলেন আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের গুণে গুণী। সেই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলেন নিজ প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করিয়া। এই আনুগত্যই কোরবানী তথা ইসলামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। আল্লাহপাক তাই হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে উত্তম আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন। পাক কালামে আল্লাহতায়ালা “উসওয়ায়ে হাসানা” (অর্থাৎ উত্তম আদর্শ) শব্দটি তিন জায়গায় ব্যবহার করিয়াছেন। প্রথমতঃ সূরা আহযাবে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে আছে অতি উৎকৃষ্ট নমুনা সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহতায়ালার সাক্ষাতের এবং শেষ বিচারের দিনের আশা রাখে এবং আল্লাহতায়ালাকে অত্যন্ত বেশী স্মরণ করে এবং দ্বিতীয়তঃ দুইবার উক্ত উস্‌ওয়ায়ে হাসানা শব্দ ব্যবহৃত হয় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে।

 

সূরা মম্‌তাহিনায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, “হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাহার সাথীদের জীবনে তোমাদের জন্য অবশ্যই এক সুন্দর আদর্শ রহিয়াছে।”

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর জীবনের যে আদর্শের কথা আল্লাহপাক উল্লেখ করিয়াছেন-তাহা হইল আল্লাহর সমীপে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও পরিপূর্ণ আনুগত্য-যাহা হাকীকী ইসলামের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আদর্শের অনুসরণের গুণ বা যোগ্যতা অর্জন করাতো সহজ কথা নয়। সেই জন্য প্রয়োজন মানুষের ভিতরের পশু বা খায়েশাতে নাফ্‌সকে কোরবানী করা অর্থাৎ গায়ের আল্লাহর মহব্বত দেল হইতে দূর করা তথা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করা। ইহাই কোরবানীর হকিকত। আর এই হকিকতেরই যেল বা প্রতিবিম্ব হইল গরু, ছাগল, ভেড়া বা উট তথা জাগতিক পশু কোরবানী।
পাক কালামে প্রকাশঃ
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ ۚ (22:37)
অর্থাৎ- “কুরবাণীর রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, ইহার গোশতও না। বরং তাহার কাছে পৌঁছায় কেবলমাত্র তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ্বঃ ৩৭)
হযরত আল্লামা শিবলী নোমানী (রঃ) ছাহেব তদীয় সীরাতুন্নবীতে বলেন, “হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানী শুধুমাত্র রক্ত এবং গোশতের কোরবানী ছিল না। বরং তাহা ছিল স্বীয় প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সামনে উৎসর্গ করা এবং রূহ ও অন্তর উৎসর্গ করা। ইহা ছিল একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর মহব্বতকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করা। ইহা ছিল আল্লাহর আনুগত্য ও উবুদিয়াত।

 

ইহা ছিল উৎসর্গ ও সন্তুষ্টির; ধৈর্য ও শোকর গোজারীর পরীক্ষা-যাহা পরিপূর্ণ করা ছাড়া দুনিয়ার নেতৃত্ব এবং আখেরাতের পুণ্যময় শুভফল লাভ করা যায় না। এই কোরবানী শুধু একমাত্র প্রাণাধিক পুত্রের রক্তে পৃথিবীকে রঞ্জিত করা ছিল না; বরং আল্লাহর সামনে নিজের যাবতীয় কামনা-বাসনা, আশা-আকাংখা, চিত্ত তাড়না ও উদগ্র চাহিদার কোরবানী এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের সকল প্রকার ইচ্ছা ও মর্জিকে বিলীন করিয়া দেওয়া। বস্তুতঃ বাহ্যিক পশু কোরবানী সেই অভ্যন্তরীণ রূপরেখার জাগতিক ছায়া।”

যখন জাগতিক পশু কোরবাণীর সাথে বাতেনী কোরবানী তথা খায়েশাতে নাফসের কোরবানী একত্রিত হয় তখনই হাকীকী ইসলামের সন্ধান পাওয়া যায়; তখনই শান্তির প্রকৃত ঠিকানা উদঘাটন করা যায়। নিজেকে সমর্পণের যোগ্যতাও পয়দা হয়। কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখানেই।

খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞানের আলোকে বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী(কুঃছেঃআঃ)ছাহেবের মহা পবিত্র নসিহত।
(নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, নসিহত নং ১২৭)

 

আরো পড়ুনঃ

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

Discover more from Sufibad.Com - সূফীবাদ.কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

ঈদুল আযহার তাৎপর্য

আপডেট সময় : ১০:২৬:০৩ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ জানুয়ারী ২০২৪

ঈদুল আযহার তাৎপর্যঃ

“ঈদুল আয্হা” অর্থ কোরবানীর উৎসব। ইহা ঈদুল কুরবা বা ঈদুন নাহ’র নামেও অভিহিত। কোরবানী কি? মহান খোদাতায়ালার সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে আল্লাহর নামে নির্দিষ্ট দিনে নির্দিষ্ট নিয়মে পশু জবাই করাই কোরবানী। ‘আযহা’-র মূলে আছে ‘‘উয্‌হিয়া শব্দ”-যাহার অর্থ উৎসর্গিত পশু অর্থাৎ যে সব পশু আল্লাহর নামে উৎসর্গ করা হয়। কোরবানী অনুষ্ঠিত হয় ১০-ই যিলহজ্ব-যেইদিন মিনা উপত্যকায় হাজ্জীগণ কুরবানী করেন এবং তৎপরবর্তী দুইদিনে, মতান্তরে তিন দিনে।
কোরবানীর উৎসব উদ্‌যাপনের মূলে আছে হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানীর আদর্শ স্মরণ ও অনুসরণ। আজ হইতে পাঁচ হাজার বৎসর পূর্বের কথা। স্বপেè প্রত্যাদৃষ্ট হইয়া আল্লাহর বন্ধু হযরত ইব্রাহিম খলিলুল্লাহ (আঃ) এই দিনে মিনা প্রান্তরে নিজ প্রাণাধিক পুত্রের গলায় ছুরি চালাইয়াছিলেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ১৬৫ বৎসর জীবিত ছিলেন। ৮৫ বৎসর পর্যন্ত তিনি নিঃসন্তান ছিলেন। অতঃপর আল্লাহতায়ালার নিকট তিনি সন্তানের জন্য দু’আ করেন। আল্লাহ তাঁহার দু’আ কবুল করেন। তিনি একটি সুন্দর ফুটফুটে পুত্র সন্তান লাভ করেন। পুত্রের নাম রাখেন ইসমাইল। ইসমাইল (আঃ) ধীরে ধীরে বড় হইতে থাকেন। ইব্রাহিম (আঃ) এর দেলে পুত্রের মহব্বত পয়দা হয়। পুত্র যেন তাহার দেলের কিংদাংশ দখল করিয়া নেয়। কিন্তু আল্লাহ প্রেমিকতো আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাহাকেও ভালবাসিতে পারেন না। যদি কখনও আল্লাহ ছাড়া অন্যের প্রতি কিঞ্চিৎ মহব্বতও দেলে পয়দা হয়, তবুও আল্লাহ তাহাকে ছাড়েন না। হযরত ইব্রাহিমের দেলে পুত্র ইসমাইল আসন পাতিয়াছে। ইব্রাহিম (আঃ) তদীয় পুত্রকে নিজ প্রাণ অপেক্ষা ভালবাসেন। আল্লাহ পাক তাই চান ইব্রাহিমকে (আঃ) পরীক্ষা করার। একদা নিশিতে স্বপèযোগে তাহাকে আদেশ দেওয়া হয়, ‘‘হে ইব্রাহিম! তুমি তোমার প্রাণপ্রিয় পুত্র ইসমাইলকে স্বহস্তে জবেহ কর।”

পুত্রের মহব্বত দেলে পয়দা হইলেও তিনিতো ছিলেন আল্লাহ-প্রেমিক; আল্লাহর পূর্ণ অনুগত ও সমর্পিত বান্দা। তাই আল্লাহর নির্দেশে তাঁহার মধ্যে না কোন ভয় দেখা গেল; না কোন উৎকন্ঠার সৃষ্টি হইল। তিনি পুত্রকে কোরবানী করিতে সিদ্ধান্ত লইলেন এবং পুত্রকেও আল্লাহর নিকট হইতে প্রাপ্ত প্রত্যাদেশ সম্পর্কে অবহিত করিলেন। পুত্রও নিবেদিত প্রাণ। খোদার রাস্তায় কোরবানীর কথা শুনিয়া তাহার দেলে খোদাপ্রেম যেন উথলিয়া উঠিল। তিনি তৎক্ষণাৎ পিতা ইব্রাহিম (আঃ) এর নিকট আল্লাহর রাস্তায় নিজেকে উৎসর্গ করার সম্মতি ব্যক্ত করিলেন। পিতা-পুত্র খোদা প্রেমের অগ্নি পরীক্ষার অবতীর্ণ হইলেন। পাক কালামে এই অপূর্ব ঘটনার বিবরণ নিম্নরূপে সন্নিবেশিত হইয়াছে।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) যখন বলিলেন, ‘‘হে আমার প্রাণাধিক পুত্র! আমি স্বপ্নে দেখিয়াছি যে, আমি তোমাকে জবেহ করিতেছি, এই সম্পর্কে তোমার কি অভিমত? কিশোর ইসমাইল জবাব দিলেন, হে আমার পিতা! আল্লাহর আদেশ আপনি বিনা দ্বিধায় পালন করুন। আমাকে ইন্‌শাআল্লাহ ধৈর্যশীলদের অন্তর্ভুক্ত পাইবেন।”

আল্লাহর খলিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) অতঃপর নিজ পুত্র ইসমাইলকে লইয়া মিনা উপত্যকায় যাইয়া তথায় পুত্রকে মাটিতে শোয়াইলেন, অতঃপর পুত্রের কোমল কন্ঠনালীতে ধারালো ছুরি চালনা করিতে লাগিলেন। প্রেমাস্পদ মাশুকের জন্য প্রেমিকের এমন অপূর্ব নজরানা প্রদানের দৃষ্টান্ত ইতিপূর্বে কেহ দেখিয়াছে কি? আল্লাহতায়ালা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানী কবুল করিলেন এবং পুত্রকেও ফেরত দিলেন। পুত্রের স্থলে কোরবানীর জন্য একটি বেহেশতী দুম্বা পাঠাইয়া দিলেন।

পাক কালামে প্রকাশঃ আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘অতঃপর যখন হযরত ইব্রাহিম ও ইসমাইল আল্লাহতায়ালার নিকট আত্মসমর্পণ করিলেন এবং ইব্রাহিম ইসমাইলকে জবেহ করার জন্য অবনত মস্তকে মাটিতে শোয়াইলেন, তখন আমি আহবান করিলাম, হে ইব্রাহিম! তুমি অবশ্যই তোমার স্বপেèর সত্যতা প্রমাণ করিয়াছ; নিশ্চয়ই আমি এই ভাবেই নেককার লোকদের প্রতিফল দিয়া থাকি। নিশ্চয় ইহা স্পষ্ট মহান পরীক্ষা। ইসমাইলের কোরবানী স্থলে আমি এক মহান কোরবানী দান করিয়াছি। অনাগত ভবিষ্যতে এই পৃথিবীতে আগমনকারীদের জন্য এই ঘটনাকে স্মরণ করার বাস্তব ব্যবস্থা গ্রহণ করিয়াছি। অতএব শান্তি বর্ষিত হোক ইব্রাহিমের উপর।”

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) প্রেম পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হইলেন। আল্লাহপাক তাঁহাকে খলিল উপাধিতে ভূষিত করিলেন। প্রেমাস্পদের নির্দেশে নিজ হাতে পুত্র কোরবানীর যে অপূর্ব ও অনুপম দৃষ্টান্ত তিনি স্থাপন করিলেন- সেই অপূর্ব কর্মকান্ড, ত্যাগ, উৎসর্গ ও আনুগত্যের ঘটনাকে স্মরণীয় করার জন্যে আল্লাহতায়ালা এক চমৎকার ব্যবস্থা গ্রহণ করিলেন। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর বংশধর আখেরী নবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা (সাঃ) কে কোরবানীর আদেশ দিলেন এবং তদসংগে উম্মতে মুহাম্মদীকে কোরবানীর উৎসব পালনের নির্দেশ দিলেন। আল্লাহতায়ালা রাসূলে পাক (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করিয়া বলেন,

إِنَّا أَعْطَيْنَاكَ الْكَوْثَرَ (108:1) فَصَلِّ لِرَبِّكَ وَانْحَرْ (108:2)
অর্থাৎ-‘‘আমি আপনাকে বহু কল্যাণ দান করিয়াছি। অতএব আপনি নামাজ পড়ুন এবং কোরবানী করুন।” (সূরা কাওছার)
উম্মতে মুহাম্মদীর উপর কোরবানী করার নির্দেশ আসিয়াছে। উম্মতে মুহাম্মদী ছাড়াও অন্যান্য উম্মতের উপর ইহা প্রবর্তিত হইয়াছিল। আল্লাহপাক বলেন,
وَلِكُلِّ أُمَّةٍ جَعَلْنَا مَنْسَكًا لِيَذْكُرُوا اسْمَ اللَّهِ عَلَى مَا رَزَقَهُمْ مِنْ بَهِيمَةِ الْأَنْعَامِ ۗ (22:34)
অর্থাৎ-‘‘এবং আমি নির্ধারণ করিয়াছি প্রত্যেক উম্মতের জন্য কোরবানীর নিয়ম যাহাতে তাহারা আল্লাহর (আমার) নাম স্মরণ করে গৃহপালিত চতুস্পদ পশুর উপর।” (সূরা হজ্জঃ ৩৪)

পাক কালামে আল্লাহতায়ালা আরও বলেন, ‘‘এবং তুমি ঘোষণা করিয়া দাও (হে ইব্রাহিম!) মানুষের মধ্যে হজ্জের। তাহারা আসিবে তোমার নিকট পায়ে হাঁটিয়া এবং উটে চড়িয়া-যাহা আসিবে দূর দূরান্ত হইতে-যাহাতে তাহারা শামিল হয় তাহাদের লাভের ব্যাপারসমূহে এবং স্মরণ করে আল্লাহর নাম গৃহপালিত চতুস্পদ পশুর উপরে (অর্থাৎ কোরবানী করে উহাদিগকে) যাহা তাহাদিগকে আল্লাহতায়ালা দান করিতেছেন-কতক নির্দিষ্ট দিনে। অতঃপর (হে হাজ্জীগণ!) তোমরা নিজেরাও খাও ইহা হইতে এবং অভাবীকেও দাও।” (সূরা হজ্জঃ ২৭-২৮)
কোরবানী করার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে দয়াল নবী (সাঃ) বলেন, ‘‘হে লোকসকল! (জানিয়া রাখ,) প্রত্যেক পরিবারের পক্ষে প্রত্যেক বছরই কোরবানী করা আবশ্যক।” (আবু দাউদ) কোরবানী মিল্লাতে ইব্রাহিম। প্রতি বৎসর যিলহজ্জ মাসের নির্ধারিত দিনে পশু কোরবানী দেওয়া প্রত্যেক সক্ষম ব্যক্তির জন্য ওয়াজেব (মতান্তরে সুন্নতে মোয়াক্কাদা)।

 

কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যঃ

পশু কোরবানী দেওয়া কোরবানীর জাগতিক নিদর্শন। কোরবানীর একটি অন্তর্নিহিত তাৎপর্য আছে। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানীতে মূল এবং প্রতিবিম্ব-উভয়ই ছিল। কোরবানীর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য মূল এবং পশুর গলায় ছুরি চালনা -যাহা কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের যেল বা ছায়া।

পূর্বেই বলা হইয়াছে-ইব্রাহিম (আঃ) এর দেলে পুত্রের প্রতি অনুরাগ ছিল, আসক্তি ছিল। এই পুত্র প্রেম বা পুত্রস্নেহ গায়ের আল্লাহর অন্তর্ভুক্ত। প্রেমের ময়দানে গায়ের আল্লাহর কোন স্থান নাই। আল্লাহ ব্যতীত অপরাপর সবকিছুর মহব্বত দেল হইতে ঝাড়িয়া ফেলিতে হয়; নতুবা আল্লাহ প্রেম দেলে পয়দা হয় না; ইসলামের হকিকতের সুবাসও পাওয়া যায় না। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) পুত্রের গলায় ছুরি চালাইলেন -যাহার অন্তর্নিহিত অর্থই ছিল এই যে, তদীয় দেলে যে পুত্রপ্রেম বাসা বাঁধিয়াছিল, তিনি তাহা ঝাড়িয়া ফেলিলেন, গায়ের আল্লাহর মহব্বত পরিত্যাগ করিলেন।

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) আল্লাহর নিকট পূর্ণ আত্মসমর্পণকারী ছিলেন। পাক কালামে প্রকাশঃ
إِذْ قَالَ لَهُ رَبُّهُ أَسْلِمْ ۖ (2:131)
অর্থাৎ-“যখন তাহার প্রতিপালক বলিলেন, [হে ইব্রাহিম!] আত্মসমর্পণ কর।” (সূরা বাকারাহঃ ১৩১) তিনি উত্তর করিলেন,
أَسْلَمْتُ لِرَبِّ الْعَالَمِينَ (2:131)
অর্থাৎ-‘‘বিশ্ব প্রতিপালকের সামনে আমি নিজেকে সমর্পণ করিলাম।” (সূরা বাকারাহঃ ১৩১)

যিনি নিজেকে সমর্পণ করিয়াছেন-তাহার নিজস্ব বলিয়াতো কিছু থাকার কথা নয়। তাহার কামনা বাসনা, ইচ্ছা-আকাংখা, প্রেম-ভালবাসা, জীবন-মরণ সবইতো আল্লাহর। হযরত ইব্রাহিম (আঃ) তাহার ত্যাগ ও উৎসর্গের মাধ্যমে তদীয় আনুগত্য ও আত্মসমর্পণেরই পূর্ণ পরিচয় দিলেন। আদৃষ্ট হওয়া মাত্রই পুত্রের কন্ঠনালীতে ছুরি চালনা করিলেন। এই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণই ইসলাম-যাহার পূর্ণ বিকাশ ছিল হযরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হযরত ইসমাইলের (আঃ) জীবনে। এখানে ‘ইসলাম’ শব্দের ব্যাখ্যা প্রয়োজন।

ইসলাম কি?

ইসলাম মূল ‘‘সালাম” ধাতু হইতে উৎপন্ন। ইহার ব্যুৎপত্তিগত অর্থ শান্তি, বিরোধ পরিহার বা আপোষ এবং পূর্ণ আত্মসমর্পণ। একটি অর্থের সাথে আরেকটি অর্থের গভীর সম্পর্ক বর্তমান। এই সম্পর্ক বুঝার জন্য কিছুটা আলোচনার প্রয়োজন। আমাদের এই দেহ চারটি জড় পদার্থ-আগুন, পানি, মাটি ও বাতাসের সমন¦য়ে গঠিত। উল্লিখিত চতুর্বিধ জড় উপাদানে তৈরী মানবদেহে আরও এক সত্ত্বার আবির্ভাব ঘটিয়াছে-যাহার নাম নাফসে আম্মারা। জড় উপাদানে তৈরী বিধায় নাফসে আম্মারা যাবতীয় জড় বা অন্ধকার বৈশিষ্ট্যে ভরপুর। যাবতীয় কুচিন্তা ও কুকর্ম নাফস হইতে উৎপত্তি। নাফসের জাত-স্বভাব আল্লাহর সাথে বিরোধ করা, ঝগড়া করা এবং আল্লাহর আদেশ-নিষেধ পালনের তোয়াক্কা না করা।
যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর সাথে নাফসের উপরে উল্লিখিত বিরোধ বিরাজমান থাকিবে, ততক্ষণ পর্যন্ত সত্য ইসলামের তথা শান্তির ঠিকানা পাওয়া সম্ভব নয়। তরিকতের বিধানমত তথা ওলীয়ে কামেলগণের প্রশিক্ষণ অনুযায়ী সাধনা করিলে ধীরে ধীরে নাফসের আল্লাহ বিরোধী স্বভাব বা অন্ধকার দোষসমূহ দূর হয়। নাফস এত্‌মিনানে আসে, নিজ ভুল বুঝিতে পারে এবং খোদার উপর সন্তুষ্ট হয়। খোদাতায়ালাও তাহার উপর সন্তুষ্ট হয়। ফলে ইসলাম অর্থ বিরোধ পরিহার বা আপোষ-এই আপোষের নিগুঢ় তাৎপর্য সে বুঝিতে পারে।

 

খোদার সাথে নাফসের আপোষ হয়। নাফস তাহার যাবতীয় কু-দোষসমূহ দূর করিয়া নিজ ইচ্ছাকে আল্লাহর ইচ্ছায় বিলীন করে। সে নিজেকে পূর্ণভাবে খোদার হস্তে ন্যস্ত করে। ইহাই পূর্ণ আত্মসমর্পণ। প্রথমে বিরোধ নিস্পত্তি; তৎপর আত্মসমর্পণ এবং খোদার পূর্ণ আনুগত্য। এই অবস্থাতে খোদাতায়ালা ঐ সাধকের উপর খুশী হন এবং তাহার উপর অবিরাম প্রেমের নূর বর্ষণ করিতে থাকেন। ফলে সে ব্যক্তি খোদার প্রেমে এমনই বিভোর হন যে, দুনিয়ার কোন দিকেই তাহার লক্ষ্য থাকে না; কোন কিছুর প্রতিই মহব্বত থাকে না। সে খোদার শান্তিময় প্রেমসমুদ্রে অবিরাম সাঁতার কাটিতে থাকে। ইসলাম অর্থ শান্তি-ইহার মর্মার্থ উল্লিখিত স্তরের প্রেমিক সাধকেরাই উপলব্ধি করিতে পারেন। ইসলামের হকিকতও ঐ স্তরেই নিহিত।
হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর নাফস জন্মগত পবিত্র ছিল। তদীয় নাফসের সাথে আল্লাহর কোন বিরোধ ছিল না। তাই তিনি ছিলেন আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের গুণে গুণী। সেই আনুগত্য ও আত্মসমর্পণের এক নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করিলেন নিজ প্রাণাধিক পুত্র ইসমাইলকে কোরবানী করিয়া। এই আনুগত্যই কোরবানী তথা ইসলামের অন্তর্নিহিত তাৎপর্য। আল্লাহপাক তাই হযরত ইব্রাহিম (আঃ) কে উত্তম আদর্শ হিসাবে উল্লেখ করিয়াছেন। পাক কালামে আল্লাহতায়ালা “উসওয়ায়ে হাসানা” (অর্থাৎ উত্তম আদর্শ) শব্দটি তিন জায়গায় ব্যবহার করিয়াছেন। প্রথমতঃ সূরা আহযাবে মহানবী (সাঃ) সম্পর্কে। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘‘নিশ্চয় তোমাদের জন্য আল্লাহর রাসূলের জীবনে আছে অতি উৎকৃষ্ট নমুনা সেই ব্যক্তির জন্য, যে আল্লাহতায়ালার সাক্ষাতের এবং শেষ বিচারের দিনের আশা রাখে এবং আল্লাহতায়ালাকে অত্যন্ত বেশী স্মরণ করে এবং দ্বিতীয়তঃ দুইবার উক্ত উস্‌ওয়ায়ে হাসানা শব্দ ব্যবহৃত হয় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে।

 

সূরা মম্‌তাহিনায় হযরত ইব্রাহিম (আঃ) সম্পর্কে আল্লাহতায়ালা বলেন, “হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এবং তাহার সাথীদের জীবনে তোমাদের জন্য অবশ্যই এক সুন্দর আদর্শ রহিয়াছে।”

হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর জীবনের যে আদর্শের কথা আল্লাহপাক উল্লেখ করিয়াছেন-তাহা হইল আল্লাহর সমীপে পূর্ণ আত্মসমর্পণ ও পরিপূর্ণ আনুগত্য-যাহা হাকীকী ইসলামের বৈশিষ্ট্য। কিন্তু হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর আদর্শের অনুসরণের গুণ বা যোগ্যতা অর্জন করাতো সহজ কথা নয়। সেই জন্য প্রয়োজন মানুষের ভিতরের পশু বা খায়েশাতে নাফ্‌সকে কোরবানী করা অর্থাৎ গায়ের আল্লাহর মহব্বত দেল হইতে দূর করা তথা কামনা-বাসনা পরিত্যাগ করা। ইহাই কোরবানীর হকিকত। আর এই হকিকতেরই যেল বা প্রতিবিম্ব হইল গরু, ছাগল, ভেড়া বা উট তথা জাগতিক পশু কোরবানী।
পাক কালামে প্রকাশঃ
لَنْ يَنَالَ اللَّهَ لُحُومُهَا وَلَا دِمَاؤُهَا وَلَكِنْ يَنَالُهُ التَّقْوَى مِنْكُمْ ۚ (22:37)
অর্থাৎ- “কুরবাণীর রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, ইহার গোশতও না। বরং তাহার কাছে পৌঁছায় কেবলমাত্র তোমাদের তাকওয়া।” (সূরা হজ্জ্বঃ ৩৭)
হযরত আল্লামা শিবলী নোমানী (রঃ) ছাহেব তদীয় সীরাতুন্নবীতে বলেন, “হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এর কোরবানী শুধুমাত্র রক্ত এবং গোশতের কোরবানী ছিল না। বরং তাহা ছিল স্বীয় প্রিয়তম বস্তুকে আল্লাহর সামনে উৎসর্গ করা এবং রূহ ও অন্তর উৎসর্গ করা। ইহা ছিল একমাত্র আল্লাহ ছাড়া অন্য সব কিছুর মহব্বতকে আল্লাহর রাস্তায় উৎসর্গ করা। ইহা ছিল আল্লাহর আনুগত্য ও উবুদিয়াত।

 

ইহা ছিল উৎসর্গ ও সন্তুষ্টির; ধৈর্য ও শোকর গোজারীর পরীক্ষা-যাহা পরিপূর্ণ করা ছাড়া দুনিয়ার নেতৃত্ব এবং আখেরাতের পুণ্যময় শুভফল লাভ করা যায় না। এই কোরবানী শুধু একমাত্র প্রাণাধিক পুত্রের রক্তে পৃথিবীকে রঞ্জিত করা ছিল না; বরং আল্লাহর সামনে নিজের যাবতীয় কামনা-বাসনা, আশা-আকাংখা, চিত্ত তাড়না ও উদগ্র চাহিদার কোরবানী এবং আল্লাহর নির্দেশের সামনে নিজের সকল প্রকার ইচ্ছা ও মর্জিকে বিলীন করিয়া দেওয়া। বস্তুতঃ বাহ্যিক পশু কোরবানী সেই অভ্যন্তরীণ রূপরেখার জাগতিক ছায়া।”

যখন জাগতিক পশু কোরবাণীর সাথে বাতেনী কোরবানী তথা খায়েশাতে নাফসের কোরবানী একত্রিত হয় তখনই হাকীকী ইসলামের সন্ধান পাওয়া যায়; তখনই শান্তির প্রকৃত ঠিকানা উদঘাটন করা যায়। নিজেকে সমর্পণের যোগ্যতাও পয়দা হয়। কোরবানীর অন্তর্নিহিত তাৎপর্য এখানেই।

খোদাপ্রাপ্তি জ্ঞানের আলোকে বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী(কুঃছেঃআঃ)ছাহেবের মহা পবিত্র নসিহত।
(নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, নসিহত নং ১২৭)

 

আরো পড়ুনঃ