আমি ইসলামের সন্তান, আদমের বংশধর – হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)
- আপডেট সময় : ১২:১৬:৫৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৭ জানুয়ারী ২০২৪
- / ২৪৭৫ বার পড়া হয়েছে
বংশ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে ইসলাম গ্রহনের পর এভাবে যিনি উত্তর দিতেন তিনি হলেন ধার্মিক, রহস্যময়, ফকীহ, জ্ঞানী, দরবেশ ও রাসূল (সাঃ) প্রিয় সাহাবী হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)।
মহান খোদাতায়ালা রাসূলে পাক (সাঃ) এঁর আহলে বায়াত ও সালমান ফারসী (রাঃ) কে নিম্নের আয়াত দ্বারা একত্রিত করছেনঃ
“যেন আল্লাহ তোমার অতীত ও ভবিষ্যত ত্রুটি সমূহ মাজর্না করেন।” (সূরা-ফাতহ, আয়াত-২)।
রাসূলে পাক (সাঃ) এঁর আহলে বায়াত ছিলেন পুতঃপবিত্র ও ক্ষমা প্রাপ্ত। রাসূল পাক (সাঃ) সরাসরি বংশ না হওয়ার পরে ও রাসূল (সাঃ) বলতেন, “সালমান আমার পরিবারে অন্তভূর্ক্ত”।
ইসলাম গ্রহনের পর জীবনের বেশির ভাগ সময় দয়াল নবী (সাঃ) সোহবতে ছিলেন। এ কারনে তিনি ইলম ও মারফতের জ্ঞানে বিশেষ পারদর্শিতা লাভ করেন।
হয়রত আলী (রাঃ) হযরত সালমান ফারসীর জ্ঞান সম্পর্কে বলতেন, “সালমান ইলম ও হিকমতের ক্ষেত্রে লোকমান হাকিমের সমতূল্য”।
অন্য একটি বর্ননা মতে আলী (রাঃ) বলেন, “ইলমে আউয়াল ও ইলমে আখের সহ সকল ইলমের আলিম ছিলেন সালমান”।
অবশ্য তরিকতের অন্যতম মাশায়েখ হযরত ইমাম জাফর সাদেক (রাঃ) বলেন, “তিনি লোকমান (আঃ) এর চেয়েও বেশি জ্ঞানি ছিলেন”।
হযরত মুয়াজ বিন জাবাল (রাঃ) বলেন, “চার ব্যক্তির থেকে ইলম হাসিল করবে। সেই চারজনের একজন সালমান”।
ইসলাম গ্রহনের পর হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) এবং দয়াল নবী (সাঃ) গভীর রাত পযর্ন্ত নিরবিলি কথা বলতেন।হযরত আবু দারদা (রাঃ) বলেন, “যখন দয়াল নবী (সাঃ) ও সালমাল (রাঃ) এক সাথে মিলিত হতেন তখন দয়াল নবী (সাঃ) অন্য কাউকে খুঁজতেন না”।
হযরত রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা বলেন, “রাসূল (সাঃ) যে দিন রাতে সালমানের সাথে নিভৃতে আলোচনা করতে বসতেন, আমরা তাঁর স্ত্রীরা ধারনা করতাম সালমান হয়তো ( আলোচনা দীর্ঘতার কারনে) আজ আমাদের রাতের সান্নিধ্যটুকু কেড়ে নেবে।”
এমনি ছিলেন দয়াল নবী (সাঃ) এঁর সাথে সালমান ফারসী (রাঃ) প্রেম।সারা আরবের বিভিন্ন গোত্র কুরাইশদের সাথে ঐক্যবদ্ধ হয়ে মদীনায় আক্রমনের প্রস্তুতি নেয়। খবর পেয়ে রাসূল (সাঃ) সাহাবিদের সাথে পরার্মশ করেন। অনেকে অনেক রকম পরামর্শ দেন। কিন্তু হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন, পারস্যে পরিখা খনন করে নগরের হিফাজত করা হয়।
মদিনার অরক্ষিত দিকে পরিখা খনন করে নগরীর হিফাজত করা সমিচিন। এ পরার্মশ দয়াল নবী (সাঃ) মনঃপূত হয়। তারপর মদীনার পশ্চিম ও উত্তর পশ্চিম দিকে সুদীর্ঘ পরিখা খনন করে মদিনা বিশাল কুরাইশ বাহিনীর আক্রমন থেকে রক্ষা করা হয়। দয়াল নবী (সাঃ) স্বয়ং এই পরিখা খননের কাজে অংশগ্রহন করেন।
হযরত সালমান ফারসি (রাঃ) প্রথম কোরআন মাজিদের অনুবাদক। তিনি পবিত্র কালামের কিছু অংশ ফার্সি ভাষায় অনুবাদ করেন।
হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বর্তমান ইরানের ইস্পাহান নামক স্থানে জায়্য নগরীতে জরাথ্রুস্টবাদি এক পরিবারে জন্মগ্রহন করেন।
বাবা ছিলেন গ্রামের সর্রদার। সবার্ধিক ধনবান ও উচ্চ মর্যাদার অধীকারী। বাবার কাছে তিনি ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রিয়। তাই তিঁনার বাবা সন্তানের অমঙ্গলের আশংকায় মেয়েদের মত তিঁনাকে ঘরের আবদ্ধ করে রাখেন।
বাবা-মায়ের ধর্মে কঠোর সাধনা করে অল্প সময়ের মধ্যে আগুনের উপাস্যের তত্ত্বাবধায়কের পদটি লাভ করেন। একদিন কারন বসতঃ তিঁনার বাবা বাড়িতে কাজে আটকে গেলে সালমান (রাঃ) কে খামার দেখাশুনা করার জন্য পাঠালেন পথের মধ্যে হঠাৎ গীর্জা থেকে খৃষ্টান ধর্মাবলম্বিদের প্রার্থনার আওয়াজ তিনার কানে আসলো। তিনি গীর্জার ভিতরে প্রবেশ করে ভাবলেন বাবা-মা যে ধর্ম পালন করে তার থেকে খৃষ্টান ধর্ম উত্তম।
তিনি পাদ্রী কে জিগাসা করলেন, এই ধর্মের মূল উৎস কোথায়?
পাদ্রি বললোঃ শামে।
সুযোগ বুজে বন্দীদশা থেকে পালিয়ে শামের অভিমুখে খৃষ্টানদের সাথে কাফেলায় যোগ দিলেন। শামে পৌছে তিনি জিগাসা করলেন, এ ধর্মের সবচেয়ে জ্ঞানি ব্যক্তি কে?
তারা বললোঃ গীর্জার পুরোহিত।
তিনি পুরোহিতের কাছে গেলেন এবং একনিষ্ঠ ভাবে খেদমত করতে লাগলেন, কিছু দিন খেদমত করার পর বুজলেন পুরোহিত লোকটা অসৎ।
এই ভাবে ঘুরে ঘুরে তিনি বিভিন্ন পাদ্রীর কাছে যেতে থাকলেন এবং তাদের খেদমত থাকতেন।
বিভিন্ন পাদ্রীর অসিহত মতে তিনি কখনো নাস্ফিবিনের কাছে আবার কখন অমুন নামে আম্মুরিয়াতের এক জ্ঞানি লোকের কাছে গেলেন। আম্মুরিয়াতের ঐ জ্ঞানি ব্যক্তির মৃত্যুর সময় সালমান কে অসিহত করেন, “অদূর ভবিষ্যতে আরবে ইব্রাহিমের দ্বীন নতুন ভাবে প্রতিষ্ঠার জন্য মহা পুরুষ আসবে, তুমি তার কাছে যাও। এবং ঐ মহা পুরুষ তাঁর জন্মভূমি থেকে বিতায়িত হয়ে পাথরের যমিনের মাঝখানে খেজুর উদ্যানবিশিষ্ট ভূমির দিকে হিজরত করবেন। তিনি হাদিয়ার জিনিস খাবেন কিন্তু সদকার জিনিস খাবেন না। তাঁর দু’কাধেঁর মাঝখানে নবুওয়াতের মোহর থাকবে। তুমি পারলে সে দেশে যাও।”
ঘনাটাক্রমে এক ইহুদির দাস হিসাবে তিনি মদিনায় এসে পৌছান। তখন দয়াল নবী (সাঃ) মক্কায় ইসলামের দাওয়াত দিচ্ছেন।
কিছুদিন পর নবী (সাঃ) মদীনায় হিজরত করলেন। তিনি তিনি খবর পেয়ে কিছু খেজুর নিয়ে ( আম্মুরিয়ার উপদেশমত) নবিজিকে দিয়ে বললেন, আমি এগুলো সদকার উদ্দেশ্যে আপনাদর জন্য এনেছি, আপনি গ্রহন করুন। কিন্তু দয়াল নবী (সাঃ) নিজে না খেয়ে সাহাবী (রাঃ) দের কে খেতে দিলেন।
তারপর একদিন কিছু খেজুর নিয়ে দয়াল নবী (সাঃ) নিকটে গিয়ে বললেন, আপনি তো সদকা খান না তাই আজকে আপনার জন্য কিছু খেজুর হাদিয়া হিসাবে এনেছি আপনি গ্রহন করুন। দয়াল নবী (সাঃ) খেজুর গুলো খেলেন এবং সাহাবিদের কেও খেতে দিলেন।
আম্মুরিয়ার জ্ঞানি ব্যক্তির সকল কথা মিলে যাচ্ছে, মহা পুরুষ হিজরত করলেন, সদকা খেলেন না, হাদিয়া গ্রহন করলেন।
এবার ছিলো নবুয়াতের মোহর দেখার অপেক্ষা।
নবী (সাঃ) একদিন ‘ বাকি আল গারকাদ’ গোনস্তানে তাঁর এক সঙ্গীকে দাফন করছিলেন।
হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) বলেন, আমি দেখলাম তিনি (দয়াল নবী (সাঃ) এক ধরনের ঢিলা পোশাক জড়িয়ে বসে আছেন। আমি তাঁকে সালাম দিলাম। তারপর তাঁর পিছনের দিকে দৃষ্টি ঘোরাতে লাগলাম নবুয়াতের মোহরটি দেখার জন্য। দয়াল নবী (সাঃ) আমার ঘন ঘন তাকানোর উদ্দেশ্যে বুজতে পেরে তিঁনার পিঠ মোবারকের চাদর সরিয়ে নিলেন, আমি মোহরটি স্পষ্ট দেখতে পেলাম ( আল্লাহু আকবার)।
“তখন আমি নিশ্চিত হয়ে গেলাম তিনিই সেই মহা পুরুষ। সাথে সাথে তিনার কদম পাকে হুমড়ি খেয়ে পড়লাম এবং কদম পাক চুমুতে ভরে দিলাম ও কেদেঁ চোখের পানিতে বুক ভাসলাম। তারপর সত্য ইসলামে দাখিল হলাম।”
তারপর দয়াল নবী (সাঃ) তিন’শ খেজুর চারা লাগিয়ে দিবেন এবং চল্লিশ উকিয়া স্বর্ন মোহর দিয়ে ইহুদির কাছ থেকে হযরত সালমান ফারসী (রাঃ)’কে দাসত্ব মুক্ত করান।
ইসলাম গ্রহের পূর্বে তিনার নাম ছিলো মাহিব ইবনে বুজখশান। ইসলাম গ্রহনের পর নবী (সাঃ) তাঁর নাম রাখেন সালমান আল খায়ের।
ইসলাম গ্রহনের পর বদর ও উহুদ যুদ্ধ ছাড়া বাকি সকল যুদ্ধে তিনি অংশগ্রহন করেন।
হযরত রাসূল (সাঃ) ওফাতের পরে তিনি কিছু দিন মদিনায় থাকেন। তারপর তিনি ইরাকের মাদায়ানে চলে যান।
তিনি ৬০ টি হাদিস বর্ননা করেন। তিনি মুসাফিরে মত জীবন যাপন করতেন। তিনি জিবনে কোনদিন বাড়ি তৈরি করেন নি। তবে একদিন দ্বীনি ভাইয়ের অনুরোধ ছোট্ট একটি জুপড়ি ঘরের মত ঘর তৈরী করেন যেখানে দাড়াঁলে তিনার মাথা ঘরের চালে লেগে যেত। কোথাও কোন প্রাচির বা গাছের ছায়া পেলে তিনি শুয়ে যেতেন।
তিনার একপুত্র ও তিন কন্যা সন্তান ছিলো।
হযরত উমর (রাঃ) তাঁকে মাদায়েনের শাসক কর্তা হিসাবে নিয়োগ দেন। এবং শাসন কর্তা থাকা কালিন সময়ে ২৫০ বৎসর বয়সে (কোন বর্ননায় ৩৫০ বৎসর) ৩৬ হিজরিতে মাদায়েনে এই মহান পুরুষ ইন্তেকাল করেন।
ইন্তেকালের সময় তিনার ঘরে একটি বড় পিয়ালা, তামার একটি থালা ও একটি পানির পাত্র ছাড়া আর কিছুই ছিলো না (যদিও তিনি শাসন কর্তা ছিলেন)।
হযরত সালমান ফারসী (রাঃ) রাসূল (সাঃ) সান্নিধ্য লাভের সাথে সাথে হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)’র নিকট থেকে এলমে বাতেন অর্জন করেন।
তিনি তরিকায়ে নকশবন্দিয়া-মুজাদেদ্দীয়ার তৃতীয় মুর্শেদ।
হযরত সালমান ফারসি (রাঃ)’র নিকট থেকে খিলাফত লাভ করেন ইমাম কাসেম ইবনে মোহাম্মদ ইবনে আবু বকর সিদ্দিক (রাঃ)।
এই নকশবন্দিয়া-মুজাদেদ্দীয়া তরিকার সিলসিলা আজও পৃথিবীতে বর্তমান। আর বর্তমান পৃথিবীতে এই সিলসিলার এক মাত্র ধারক-বাহক বিশ্বওলী শাহসূফী হযরত খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের স্থলাভিষিক্ত আলহাজ্ব খাজা মিয়া ভাইজান মুজাদ্দেদী ছাহেব।