সূফীদের রোজা
- আপডেট সময় : ০৩:৫৬:০৬ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১৬ ফেব্রুয়ারী ২০২৪
- / ২৪৭৬ বার পড়া হয়েছে
“হে মুমিনগন! তোমাদের জন্য সিয়ামের বিধান দেওয়া হলো, যেমন বিধান তোমাদের পূর্ববর্তীগনকে দেওয়া হয়েছিল, যাতে তোমরা মুত্তাকি হতে পার।”
– সূরা বাকারাঃ ১৮৩
রোজা পালন করা একটু কষ্টসাধ্য কাজ। তাই আল্লাহপাক প্রথমেই অতি আদরে ডাকলেন, ” হে ঈমানদারগন! তারপর রোজার উদ্দেশ্যে হলো, “আমাদেরকে মোত্তাকি মুমিন বানানো। তরিকতের পরিভাষায় মোত্তাকি হলো মানব স্তরের ২৭টির মধ্যে ৫ম স্তর। ১ম স্তর সাধারন মানুষ, ২য় স্তর মুমিন, ৩য় স্তর সাধারন ওলী, ৪র্থ স্তর শহীদ, ৫ম স্তর মোত্তাকি।
হযরত আবু হুরায়রা (রাঃ) হতে বর্নিত, রাসূল (সাঃ) ইরশাদ করেন, ” সিয়াম ঢাল স্বরুপ। তোমাদের কেউ কোনোদিন সিয়াম পালন করলে তার মুখ থেকে যেন অশ্লীল কথা বের না হয়। কেউ যদি তাকে গালমন্দ করে অথবা ঝগড়ায় প্ররোচিত করতে চায় সে যেন বলে, আমি রোজদার।”-বোখারি শরীফঃ ১৮৯৪
বিশ্বওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেব ফরমান, ” রমজান নেকী অর্জনের মওসুম। এই মাসে যত সহজে যত অধিক নেকি অর্জন করা যায় তাহা অন্য মাসে সম্ভব নহে। রমজানে ইবাদতের পরিমান বৃদ্ধি পায়। দিনে রোজা রাত্রে বন্দেগী। দিবারাত্র ব্যাপি চলে ইবাদত। অন্যদিকে প্রত্যেক ইবাদতের বিনিময়ে নেকি বৃদ্ধি করা হয় কমপক্ষে ৭০ গুন। যার কারনে রমজানকে বলা হয় নেকীর মওসুম”।
শরীয়তে ও তরিকতে রোজা:
শরীয়তে রোযাঃ ঈমান সহকারে ইবাদতের নিয়তে সেহরী থেকে ইফতার পর্যন্ত পানাহার ও প্রবৃত্তির কামনা থেকে নিজকে বিরত রাখা।
তরিকতের রোযাঃ ঈমানদার ব্যক্তির প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে, দিনে ও রাতে সর্বাবস্থায় যাবতীয় হারাম ও নিষিদ্ধ কর্ম থেকে বিরত থাকা, অহংকার, ধোঁকা, পরনিন্দাসহ সকল প্রকার অসৎকর্ম ও কু-স্বভাব থেকে বিরত থাকা এবং কোন প্রকার পাপকর্মে নিবিষ্ট না হওয়া। আর যদি এক মুহূর্তের জন্যও পাপকর্ম সংঘটিত হয়ে যায় তাহলে তরিকতের রোযা বিনষ্ট হয়ে যাবে।
হযরত রাসূল (সাঃ) ফরমান, ” অনেক রোযাদার এমনও রয়েছে যাদের থেকে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ব্যতীত কিছুই অর্জিত হয় না।”
অর্থাৎ মানুষ আল্লাহর হুকুমে রোযা পালন করে। অনেক রোযাদার আছে সে রোযা থাকলো কিন্তু পাপকাজ থেকে দূরে থাকলো না সে তার হস্ত-পদ, চক্ষু-কর্ন দ্বারা নিয়মিত পাপ করে গেলো। তার রোজা থেকে সে ক্ষুধা ও তৃষ্ণা ব্যতিত কিছুই অর্জন করে না।
তিঁনি আরও ফরমান, ” অনেক রোযাদার ব্যক্তি ইফতারকারি আর অনেক ইফতারকারি ব্যক্তি রোযাদার হয়ে থাকে।”
অর্থাৎ অনেক রোযাদার সত্যিকারার্থে রোযা রাখে এবং স্বীয় অঙ্গ-প্রতঙ্গকে যাবতীয় অপকর্ম থেকে নিরাপদ রাখে। পক্ষান্তরে অনেক রোযাদার নামসর্বস্ব রোযা রাখে। রোযা পালন করা সত্ত্বেও তারা নিষিদ্ধ ও অবৈধ কার্যাদি থেকে নিজকে সংবরন করে না। তারা নিশ্চিতভাবে রোযার সওয়াব থেকে বঞ্চিত থাকবে।
দয়াল নবী রাসূল (সাঃ) ফরমান, “রোযাদারের জন্য দুটি আনন্দঘন মুহূর্ত রয়েছে, একটি ইফতার তথা রোযা ভঙ্গের সময় আর অপরটি আল্লাহ তা’য়ালার দীদার লাভের সময়।”
অর্থাৎ শরিয়তের ইফতার বলতে সূর্যাস্তের সময় রোযা ভঙ্গ করার মুহূর্ত আর রোযা ভঙ্গের জন্য (ইফতারের সময় নির্ধারনের জন্য) আসমানের দিকে তাকানো হলো ঈদের চাঁদের মত যা দেখে মন আনন্দিত হয়। তরিকতের রোযার ইফতার হলো জান্নাতে প্রবেশের মুহূর্ত। তারা জান্নাতে প্রবেশ করে সেখানের যেসকল নেয়ামত প্রাপ্ত হবে তা দিয়ে তারা ইফতার করবে। আর ইফতারের সময় নির্ধারনের জন্য আসমানে দিকে তাকানোর উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর সৌন্দর্য দর্শনে বিমোহিত হওয়া।
হযরত আব্দুল কাদের জিলানি (রহঃ) ফরমান, “পানাহার এবং যা কিছু করলে রোজা ভঙ্গ হয়, তা করা থেকে বিরত থাকা শরিয়তের বিধানমতে রোজা। অপরপক্ষে হারাম, কুপ্রবৃত্তি, লোভ-লালসা ও নিষেধ সব কাজ থেকে বিরত থাকাই তরিকতের রোজা। “
হযরত জুনাইদ বোগদাদি (রহঃ) ফরমান, ” রোজা তরিকতের অর্ধাংশ। মানুষ তার ইন্দ্রিয় অর্থাৎ চোখ, কান, নাসিকা, জিহ্বা ত্বক ইত্যাদি দ্বারা নেক ও পাপ কাজ করতে পারে। এ ইন্দ্রিয় গুলো আল্লাহর আনুগত্য ও নাফরমানির জন্য সমান উপযোগী। মানুষের ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে সে নিজ ইন্দ্রিয়গুলো নিয়ন্ত্রনে রেখে তা ইলম, আকল ও রুহের মাধ্যমে ব্যবহারেরর চেষ্টা করবে কিংবা নফসের কামনা -বাসনার ওপরে ছেড়ে দিবে। এগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য রোজা পালনের চেয়ে উত্তম কোনো উপায় নাই।
-হুজ্জাতুল ইসলাম হযরত ইমাম গাজ্জালি (রহঃ) মযার্দা হিসাবে রোজাকে তিন শ্রেনীতে ভাগ করছেনঃ
-নিন্ম শ্রেনীর রোজাঃ শুধু পানাহার থেকে বিরত থাকা। নানাবিধ গোনাহের কাজ থেকে বিরত থাকার চিন্তা থাকে না।
১.মধ্যম শ্রেনীর রোযাঃ পানাহার প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার পাশাপাশি সব পাপ থেকে আত্নরক্ষা করা যেমন মুখ ও জিহ্বা সংযত করা, অনর্থক গালি না দেয়া ইত্যাদি।
২. উচ্চশ্রেনীর রোযাঃ এ শ্রেনীর রোযা পানাহার প্রভৃতি থেকে বিরত থাকার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গপ্রতঙ্গকে পাপকাজ থেকে বিরত রাখা হয় অপরদিকে মনকেও কুপ্রভাব, কুচিন্তা থেকে পবিত্র রাখা এবং আল্লাহর ধ্যান ও ইবাদত-বন্দেগির মাধ্যমে রোযাকে সমৃদ্ধ করা হয়। “
জাকেরানদের ইমাম বর্তমান যামানার হাদী হযরত খাজা মিয়া ভাইজান মুজাদ্দেদী (মাঃজিঃআঃ) ছাহেব ফরমান, “আমলের (action) অন্তর্গত দ্বিতীয় স্তম্ভটি ‘রোজা’ ( swam) আত্নসংযমই (self-restraint) ইহার মুখ্য উদ্দেশ্য। দেহ এবং আত্না এই দুই-এর সমন্বয়ই মানব। প্রত্যেক বস্তুই তাহার আসলের (origin) দিকে ধাবিত হয়। সেইসূত্রে আত্নারও গতি সেদিকে যেখান হইতে তাহার উৎপত্তি হইয়াছে-অর্থাৎ আল্লাহতায়ালার দিকে আত্নার বিশুদ্ধিকরণের ( purification of soul) দ্বারাই মানব হৃদয়ে সৃষ্টি ও স্রষ্টার প্রকৃতরূপ উদ্ভাসিত হয়। আল্লাহতায়ালার সম্পর্কে বিশুদ্ধ আত্নার সহিত। মানব আত্নার মধ্যেই তাঁহাকে অনুধাবন করিতে হয়। অন্য দিকে আত্নার সহিত নাফস (self) এর সম্পর্ক রহিয়াছে এবং নাফস এর সাথে ‘বাহ্যিক-দেহ’ (carnal existence) সম্পর্কযুক্ত। মানুষের এই ‘বাহ্যিক দেহে’র মধ্যেই উৎপত্তি লাভ করে বিভিন্ন প্রকার ‘রিপুর তাড়না’ (carnal desire)। নাফসকে সঠিক পরিচালনা করিতে হইলে ‘রিপু’কে বাহ্যিক দেহে’র এবং নাফস এর নিয়ন্ত্রণাধীন রাখা একান্ত প্রয়োজন। আত্না, নাফস এবং বাহ্যিক দেহের মধ্যকার এই সম্পর্ক বিশ্লেষণ করিলেই আমরা রোজার প্রকৃত উদ্দেশ্য অনুধাবন করিতে পারি। পানাহার হইতে নিয়মানুগ বিরতি রোজার প্রায়োগিক অবস্থা (empirical implication)। একই সঙ্গে অন্তরকে বিভিন্ন প্রকার রিপুর তাড়না (carnal desire) হইতে মুক্ত রাখিয়া আত্নার বিশুদ্ধিকরণ ইহার বিশেষ অবস্থা (spicified implication)। রোজার এই দুইটি অবস্থা মানব চরিত্রের বিভিন্ন দিকের উপর প্রভাব বিস্তার করে এবং মানুষকে সত্যবাদী, সংযমী, সদাচারী, মিতব্যয়ী হইতে শিক্ষা দেয় এবং একই সাথে আত্নার বিশুদ্ধিকরণের সহায়ক হয়। তাই রোজা ইসলামের একটি অন্যতম মূলভিত্তি নির্ধারিত হইয়াছে।”
হাসিদে কুদসিতে আল্লাহপাক বলেন, ” মানুষ আমার গুপ্তরহস্য আর আমি তার গুপ্তরহস্য”। গুপ্তরহস্যটা হচ্ছে আল্লাহর নূর। প্রত্যক মানুষ সেই নূরের দিকে নিবিষ্ট থাকবে অন্য কোনো দিকে নিবিষ্টি হবে না বা হতে পারে না। দুনিয়া আখেরাত দু জগতেই মহান খোদাতায়ালা ব্যতিত প্রিয়, পছন্দনীয় ও কাম্য কিছু ই নাই। যদি মানুষ রোযা থাকা অবস্থা দুনিয়ার প্রেমে পড়ে যায় তখন তরিকতে তার রোযা বিনিষ্ট হয়ে যায়।
আল্লাহপাক হাদিসে কুদসিতে ফরমান, “রোযা আমার জন্য এর প্রতিদান আমি নিজেই দিবো” প্রতিদান টা ই আল্লাহর দিদার।