ঢাকা ১০:৩৫ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪, ২০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আটরশি পীরের জীবনী

  • আপডেট সময় : ১০:৪৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ মার্চ ২০২৪
  • / ২৪০১ বার পড়া হয়েছে

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পটভূমি এবং আটরশির পীরের জীবনের দু'টি কথা

Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

আটরশি পীরের জীবনী

আটরশি পীরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানা, আটরশি গ্রামে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল অবস্থিত। যার প্রতিষ্ঠাতা শাহসুফী খাজা হাশমত উল্লাহ (রহ:)। তিনি বিশ্ব ওলি খাজাবাবা ফরিদপুরী নামেই বেশি পরিচিত। যিনি খাজা এনায়েতপুরী (শাহসুফী মুহাম্মদ ইউনুস আলী এনায়েতপুরী রহ:)’র মুরিদ ও খলীফা। জনাব খাজা হাশমত উল্লাহ ফরিদপুরী (রহ:) সাহেব জামালপুর জেলার শেরপুর থানার পাকুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

দশ বৎসর বয়সে তিনার পিতা শাহ আলীমউদ্দীন সাহেব তিনাকে খাজা এনায়েতপুরীর হাতে অর্পণ করেন। ত্রিশ বৎসর তিনি এনায়েতপুরীর কাছে থেকে কঠর পরিশ্রমের মাধ্যমে সাধনা লাভ করেন। অতপর এনায়েতপুরীর নির্দেশে তিনি ফরিদপুর এসে “জাকের ক্যাম্প” প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তিকালে এটার নাম দেওয়া হয় “বিশ্ব জাকের মঞ্জিল”। সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের তুলনা হয় এ রকম অন্য কোন ধর্মীয় কমপ্লেক্স অন্য কোথাও দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে উক্ত জাকের মঞ্জিলে যেমনি কোটি কোটি ভক্ত মুরীদ রয়েছে, তেমনি সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়।

 

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পটভূমি এবং আমার জীবনের দু’টি কথাঃ-

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম :

বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আল্লাহ ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহা দান, বিশ্ব মানবের জন্য খোদাপ্রাপ্তির প্লাটফর্ম, আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র। দেশের সর্বত্র থেকে এখানে মানুষ আসে। আসে আত্মোপলব্ধির তাড়নায়, আসে নিজেকে চিনিবার জন্য, আসে খোদাতায়ালাকে চিনিতে, জানিতে বা বুঝিতে। আজ শুধু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই নয়; পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই লোক আসে। তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর মহব্বত অর্জনের জন্য, আসে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (সাঃ) এর শাশ্বত প্রেমের শরাব পানের জন্য।

বিশ্ব জাকের মঞ্জিল জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখানের সমস্তই মানব কল্যাণের জন্য। এই বহুমুখী প্রতিষ্ঠানে আছে আলীয়া মাদ্রাসা, সোনালী ব্যাংকের শাখা, পোষ্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, আছে ৬০০ শয্যাবিশিষ্ট(প্রস্তাবিত) একটি হাসপাতাল (নির্মাণাধীন); আছে সম্পূর্ণ পাথর নির্মিত দ্বিতল একটি মসজিদ (নির্মাণাধীন) ইহা ছাড়াও জাকেরানদের থাকিবার জন্য আছে বহু অট্টালিকা।

মাদ্রাসার ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার তালেবে মাওলাগণ আসে। তাহাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়-শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাত তথা পূর্ণাংগ ইসলাম সম্পর্কে। দিবা-নিশি ২৪ ঘন্টা চলে এই প্রশিক্ষণ কর্ম। যাহারা জাগতিক সমস্যা লইয়া আসে, সেই সমস্যা সমাধানের উপদেশ দানের মাধ্যমেই আমি তাহাদেরকে আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দেই; খোদাতায়ালার দিকে পথ দেখাই। তাহাদের প্রত্যেকের জিহ্বাতেই এক ফোটা করিয়া আধ্যাত্মিক মধু প্রদান করি; যে অমীয় মধুর মিষ্টি স্বাদে ও আকর্ষণে পুনঃপুনঃ তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর এই দরবারে, আরও অধিক মধু পানের অতৃপ্ত তৃষ্ণায়।

কাহার সাধ্য এই বিশাল মেহমানখানা পরিচালনা করে? প্রতিদিন কত লোক আসিবে, কত মেহমানকে খাবার পরিবেশন করা হইবে- তাহার হিসাব নাই। এত লোকের এক সন্ধ্যার তরকারীও কোন উপশহরে মিলে না। অথচ যখনই যত মেহমান আসে, তাহাদের সকলেরই খাবারের ব্যবস্থা থাকে। অত্যন্ত নিয়ম শৃংখলার সাথে চলে এই মেহমানখানা।
এই দরবার এমনই এক দরবার, যেখানে সুখের খানা খাওয়াইয়া, আরামের বিছানায় শোয়াইয়া খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বের তালিম দেওয়া হয়। শুধু খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্ব সম্পর্কেই নয়; তালিম (শিক্ষা) চলে পরিপূর্ণ সত্য ইসলামের উপরে, সত্য তরিকার উপরে; প্রশিক্ষণ চলে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের উপরে; দিন-রাত্রি ২৪ ঘন্টা ব্যাপিয়াই।

এই বিশাল মেহমানখানা পরিচালনা, দিবা-নিশি তালিম বা প্রশিক্ষণ দান; সুষ্ঠু ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা, ইহার সবই সম্ভব হয়-কারণ এই দরবার আল্লাহ ও রাসূলের স্বীকৃত দরবার; ইহার পরিচালনার দায়িত্ব আমার পীর কেবলাজান হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের উপরে; আমি তাঁহার পক্ষ হইতে একজন তত্ত্বাবধায়ক মাত্র।
আজকের এই শান-শওকতময় ও প্রাণমূখর বিশ্ব জাকের মঞ্জিল একদিনে গড়িয়া উঠে নাই। ইহার পিছনে আছে এই মিসকিনের দীর্ঘ ৪৫ বছরের প্রচার জীবন। আছে বিরোধী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শক্তির মোকাবেলা। ইহা ব্যতীতও আছে আটরশিতে আসিবার পূর্বে পীরের কদমে প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছরের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনাহার-অনিদ্রা, সুকঠিন ব্রত, অতিশয় শ্রম, চরম দরিদ্রতা ও কঠোর রেয়াযতের পরীক্ষা উত্তরণ।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পটভূমিকা বিশ্লেষণে, ইতিহাস বর্ণনে আমার জীবনের কিঞ্চিত বিবরণ প্রয়োজন বলিয়া মনে হয়। আমার বয়স তখন সাত কিংবা আট। সেই কৈশোর বয়সে আমার পীর, জামানার নূর, শতাব্দির মুজাদ্দেদ, হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব একবার আমাদের শেরপুরের পাকুরিয়াস্থ গ্রামের বাড়ীতে তশরিফ রাখিয়াছিলেন। তিনি প্রথমে উঠেন তদীয় এক মুরীদ নইমুদ্দিন মুনসী ছাহেবের বাড়ীতে। নইমুদ্দিন মুন্সী ছাহেবের সাথে আলাপকালে তিনি তাহাকে বলেন, ‘‘তোমাদের গ্রামের ছর্দারকে ডাকিয়া আন।” আমার আব্বাজান জনাব আলীমুদ্দিন ছাহেব মুজাদ্দেদী ছিলেন অত্র এলাকার সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। নইমুদ্দিন মুন্সী ছাহেব আমার আব্বাজানকে ডাকিয়া আনিলেন। পীর কেবলাজানের সাথে আব্বাজানের বহু সময় আলাপ আলোচনা হইল। আব্বাজান হুজুর পীর কেবলাজানের অমায়িক ব্যবহার ও উপদেশে মুগ্ধ হইলেন এবং আমাদের বাড়ীতে তদীয় কদম মোবারক রাখিবার জন্য অনুনয়-বিনয় করিলেন। কেবলাজান হুজুর রাজী হইলেন; আমাদের বাড়ীতে তশরীফ রাখিলেন। তাহার দীপ্তময় চেহারা দর্শনে আমি সেদিন মুগ্ধ হইয়াছিলাম। আমার মনে হইতেছিল, আসমান হইতে যেন দলে দলে ফেরেশতারা আমাদের বাড়ীতে অবতরণ করিতেছে; যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ-যাহা কোনদিনই ভুলিবার নয়। বহু আলাপ আলোচনার মধ্যেই পীর কেবলাজান আমাকে এবং আমার বড় ভাই মাওলানা আলতাফ হোসেন (রঃ) এর দিকে ইশারা করিয়া আব্বাজানকে বলিলেন, ‘‘বাবা, আপনার ঐ দুইটি ছেলে আমাকে দেন।” আব্বাজান হুজুর দ্বিরুক্তি না করিয়া ততক্ষনাত আমাকে এবং আমার বড় ভাই মাওলানা আলতাফ হোসেন ছাহেবকে পীর কেবলার পাক কদমে সোপর্দ করিলেন।” দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হইল। সেই দিন হইতে আমি আমার পীর কেবলাজান হযরত এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের। সেই একবারই পীর কেবলাজান শেরপুরের অজপাড়াগাঁ পাকুরিয়ায় তশরিফ রাখিয়াছিলেন; আর কখনও যান নাই। জামালপুরের বগাইদ নিবাসী মাওলানা নইমুদ্দিন ছাহেব নামক এক ব্যক্তি পীর কেবলাজান ছাহেবের অতি মহব্বতের মুরীদ ছিলেন। কেবলাজান হুজুরকে তিনি নিজের চেয়েও বেশী মহব্বত করিতেন। সব সময়ই জজবা হালাতে থাকিতেন। তিনি বাতেনী জ্ঞানসম্পন্ন মজ্জুব পাগল ছিলেন। যাহা বলিতেন, তাহা সত্য হইত। আমি এবং আমার বড় ভাই হযরত মাওলানা আলতাফ হোসেন মাঝে মাঝে তাহার নিকট যাইতাম। আমাদেরকে তিনি অতিশয় মহব্বত করিতেন। কিন্তু কেন এত ভালবাসিতেন, তাহা বুঝিতাম না। পীর কেবলাজান আমাদের বাড়ীতে তশরিফ রাখিয়াছিলেন, হয়তো সেই কারণে হইবে। তিনিই একদিন আমাদেরকে বলিলেন, ‘‘হযরত পীর কেবলাজান হুজুর যে একবার মাত্র শেরপুরের অজ পাড়াগাঁ পাকুরিয়া আসিয়াছিল, তাহা শুধুমাত্র আপনাদের দুই ভাইকে নেওয়ার জন্য।”

ইহার দুই বছর পরের কথা। আমার বয়স তখন দশ। সেই দশ বছর বয়সে আব্বাজানের সাথে আমি আমার পীর কেবলাজান, যামানার মুজাদ্দেদ, হযরত খাজাবাবা শাহসূফী এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের এনায়েতপুরস্থ দরবার শরীফে যাই। সেই হইতে শুরু হয় খোদাপ্রাপ্তির কঠোর সাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন রেয়াযত। খোদাপ্রাপ্তির পথ বড় কন্টকাকীর্ণ। এই পথে অসংখ্য পরীক্ষা দিতে হয়। কঠোর শ্রমের পরীক্ষা, দরিদ্রতার পরীক্ষা, অনাহার-অনিদ্রার পরীক্ষা, অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষা। কঠিন পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই না করিয়া খোদাতায়ালা কাহাকেও নিজ দরবারে প্রবেশের যোগ্যতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন না। প্রত্যেক সাধককেই পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষা দিয়াছেন নবী-রাসূলগণ। পরীক্ষা দিয়াছেন বিগত দিনের ওলীয়ে কামেল সকল। খোদাপ্রাপ্তির এই রাস্তায় এই মিসকিনকেও কম পরীক্ষা দিতে হয় নাই। দীর্ঘ ৪০ বছর পীরের কদমে অনাহার-অনিদ্রাসহ অমানুষিক শ্রম ও অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষা দিতে হইয়াছে। পীর কেবলাজান আমাকে তেমন খাইতে দিতেন না। অর্ধচামচ ভাত-ততসংগে যতকিঞ্চিত তরকারী আমাকে দিতেন। অধিকাংশ দিনে একবার; কখনও বা দুইবার দিতেন। অবশ্য অন্যান্য সকলকেই পেট ভরিয়া দিনে দুইবার খাবার দিতেন। খাদ্য কম দেওয়া যেন শুধু আমার জন্যই নির্ধারিত ছিল। অথচ পরিশ্রম আমাকেই সকলের চেয়ে বেশী করিতে হইত। খাদ্য কম, কাজ বেশী। আমার শরীর যেন নিস্তেজ হইয়া আসিত। ক্ষুধা পেটে,দুর্বল শরীরেই আমাকে মাটি কাটিতে হইত, ছয় মাইল দূরের খুকনী হইতে টুকরী ভর্তি বাসন আনিতে হইত। ইহা ছাড়াও যমুনা নদীর তীরে স্থলচর ঘাট হইতে গরুর গাড়ীতে তুলিয়া ধান, চাউল বা ডাউল আনিতে হইত। এমনিভাবে কঠোর খেদমত করিতে হইত। একদিন পীর কেবলাজান আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, তুমি যদি খোদাতায়ালাকে পাইতে চাও, তবে ত্যাগী হও।” বিদায় লইয়া বাড়ীতে গিয়া আব্বাজানকে পীর কেবলাজানের উক্ত উপদেশের কথা বলিলে তিনি আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, বড়ই কঠোর হুকুম। তোমাকে সর্বস্ব ত্যাগ করিতে হইবে।” অতঃপর আমি আমার সমুদয় জমি-জমা, সহায়-সম্পদ বিক্রয় করিয়া প্রাপ্ত টাকা কেবলাজান হুজুরের কদমে নজরানা দিয়া একেবারেই কপর্দকশূন্য মিছকীন হইলাম। কেবলাজানের কদমে নিরলস খেদমত করিতে থাকিলাম।

আত্বীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একে একে সবাই আমাকে ত্যাগ করিল। আমার আর আপন বলিয়া কেহই রহিল না। এমনই সে অবস্থা যেন, উড়িবার পাখা নাই; ধরিবার ডাল নাই। একমাত্র অবলম্বন ছিলেন আমার পীর কেবলাজান। সর্বস্বান্ত অবস্থায় পীরের দরবারে অনাহার-অনিদ্রাসহ কঠোর খেদমত চলে জীবনের চল্লিশটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাতে-কলমে এই মিছকিনকে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের তালিম দেন; নিজ হাতে মনের মত করিয়া গড়িয়া তোলেন। অবশেষে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান-যাহা রাসূলে পাক (সাঃ) হইতে সিনা-ব-সিনা তদীয় পবিত্র দেলে সংরক্ষিত ছিল, তাহা এই মিছকীনের কালবে প্রদানপূর্বক হেদায়েতের দায়িত্বভার অর্পণ করেন, সত্যপথচ্যুত আল্লাহভোলা মানুষদেরকে সত্যের দিকে আহবানের নির্দেশ দেন। আমি পীরের নির্দেশে এই আটরশি হইতেই সত্য তরিকা বা খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান প্রচার শুরু করি। এই আটরশিতে আসিবার ইতিহাসও অনেক গভীরে। পীর কেবলাজানের কদমে খেদমতরত অবস্থায় তিনি আমাকে প্রায়শঃই কোলকাতায় যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। বলিতেন, ‘‘কোলকাতায় যাও, চাকুরী খোঁজ।” পীরের নির্দেশ, তাই কোলকাতায় যাইতাম। কিন্তু আমিতো ছিলাম কপর্দকশূন্য। তাই ক্ষুধাপেটে, কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কে দিবে আমাকে চাকুরী? কে দিবে আমাকে খাবার? ফলে দরবারে ফিরিয়া আসিতাম। পুনরায় কেবলাজান হুজুর কোলকাতায় যাওয়ার আদেশ করিতেন। আবার কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম। এমনিভাবে বহুবার আমি কোলকাতায় গিয়াছি। মূলতঃ এই আটরশিতে আসিবার লাইনটাই ছিল কোলকাতায়।

কোলকাতায় আমি আমার মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবের বাসায় অবস্থান করিতাম। তিনি ৬ নং হায়াত খান লেনে থাকিতেন। ঐ বাসাতে আমার মামাতো ভাইয়ের সাথে আরও দুইজন থাকিতেন। তাহাদের একজন হইলেন জনাব মহসীনউদ্দিন খান ছাহেব; অপরজন হইলেন সিরাজ ছাহেব। সিরাজ ছাহেব কলিকাতার নিকটে ‘‘কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী”তে চাকুরী করিতেন। আমার মামাতো ভাই সামাদ ছাহেব কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের গবেষণা বিভাগে চাকুরী করিতেন। জনাব মহসীন খান ছাহেবের বাড়ী এই আটরশিতেই।

মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবের বাসায় অবস্থান কালে আমি এক তাতপর্যবহ স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। স্বপ্নে আমি শুনিলাম, লোকে বলাবলি করিতেছে, রাসূলে পাক (সাঃ) কলিকাতা শহরে আগমন করিতেছেন। আরও শুনিলাম, তিনি কলিকাতার সার্কুলার রোডে আসিতেছেন। সৃষ্টির সেরা মানব,রাহমাতুল্লিল আ’লামীনকে দেখিবার বাসনা কাহার না থাকে?তাহাকে এক নজর দেখিবার জন্য লক্ষ লক্ষ আশেকে রাসূলের ভিড় পড়িল। সার্কুলার রোডের এক পার্শ্বে আমিও গিয়া দাঁড়াইলাম দয়াল নবী (সাঃ) কে এক নজর দেখিবার তৃষ্ণায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখিলাম, অতীব চমতকার, নূতন মডেলের একটি মোটরযানে রাসূলে পাক (সাঃ) আসিতেছেন। এমন উন্নত মডেল ও ডিজাইনের গাড়ী কোলকাতার রাস্তায় ইতিপূর্বে আমি দেখি নাই। সকলেই রাসূলে পাক (সাঃ) এর পবিত্র বদনের দিকে অপলক নেত্রে তাকাইয়া রহিয়াছে। দেখিতে দেখিতে মোটর গাড়ীটি আমার নিকট পর্যন্ত আসিয়া থামিয়া গেল। দয়াল নবী (সাঃ) আমাকে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন। আমি নিকটে উপস্থিত হওয়া মাত্রই তিনি বলিলেন, ‘‘বাবা, তোমার উপর গযব আসিতেছে; তুমি তওবা কর।” আমি দয়াল নবী রাসূলে পাক (সাঃ) এর কদম ধরিয়া মহান খোদাতায়ালার নিকট তওবা করিলাম। বলিলাম, হে খোদা! আমি যত গোনাহ করিয়াছি, যত মনে আছে, যত ভুলিয়া গিয়াছি-সমস্ত গোনাহ হইতে তোমার নিকট দয়াল নবী (সাঃ)-এর অছিলায় তওবা করিতেছি। দয়া করিয়া তুমি আমাকে মাফ কর। রাসূলে পাক (সাঃ) বলিলেন, ‘‘আল্লাহ তোমাকে মাফ করিয়া দিয়াছেন। গজবও তুলিয়া নিয়াছেন। তবে গজবের সামান্য একটু যাহা দুনিয়াতে আসিয়া পড়িয়াছে-তাহা তোমাকে ভোগ করিতে হইবে।” নিশির শেষ ভাগ বা রহমতের সময় এই স্বপ্ন আমি দেখিলাম। আমার ঘুম ভাংগিয়া গেল। মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলিলাম। এই সময় জনাব মহসীন উদ্দিন খান ছাহেবও জাগ্রত ছিলেন। তিনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনিলেন। ঐ স্বপ্ন দেখিবার তিন দিনের দিন আমার শরীর খারাপ বোধ হইতে লাগিল। আমি মামাতো ভাইকে বলিলাম। ভাইজান, আমি যদি সংজ্ঞাহীন হই, আমার আব্রু যাহাতে হাটুর উপরে না উঠে; সেই দিকে তুমি একটু খেয়াল রাখিও। জোহরের পর সমস্ত শরীর কালো বর্ণ ধারণ করিল। আসরের সময় কম্প দিয়া জ্বর আসিল। মাগরীবের সময় আমি সংজ্ঞা হারাইয়া ফেলিলাম।
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় স্বপ্নে দেখিলাম।

কেবলাজান হুজুর হ্যারিসন রোড হইতে হায়াত খান লেনের দিকে আসিতেছেন। তাঁহার সংগে আছেন জনাব আলিম উদ্দিন সরকার ছাহেব। তিনি পীর কেবলাজান হুজুরের শ্বশুর ছিলেন। আমরা তাহাকে নানাজান বলিয়া সম্বোধন করিতাম। হযরত কেবলাজান হুজুর ৬ নং হায়াত খান লেনে আসিয়া যে ঘরে আমি শয্যাগত ছিলাম, সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার মাথার দিকে বসিলেন। আমি আবেগাব্লুত হইয়া কেবলাজানকে বলিলাম, ‘‘হুজুর, এই কলিকাতা শহরে আমার কে আছে? আমি যদি অসুস্থাবস্থায় এমন পড়িয়া থাকি, কে আমাকে দেখিবে?” পীর কেবলাজান আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, এই যে আমি তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি। আমিতো তোমার নিকটেই আছি। তোমার কোন চিন্তা নাই। তুমি এক ঘন্টার ভিতরেই সুস্থ হইবে। তিনি আরও বলিলেন, ‘‘কুইনাইন এমন” নামক একটি ঔষুধ আছে। উহার একটি ফোটা তুমি সেবন করিও। ইহাতে তুমি পূর্ণ সুস্থ হইবে। এই অর্থপূর্ণ স্বপ্ন দেখিবার পরক্ষণেই আমার সংজ্ঞাহীন ভাব কাটিয়া গেল। চক্ষু মেলিয়া দেখি, হায়াত খান লেনের বাসার সকলেই আমার শিয়রে দন্ডায়মান। দেখিলাম, সকলেই চিন্তিত, উতকন্ঠিত।

‘কুইনাইন এমন’ নামক যে ঔষুধের কথা স্বপ্নে পীর কেবলাজান ছাহেব আমাকে বলিয়াছিলেন, আমি মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবকে তাহা অনতিবিলম্বে সংগ্রহ করিতে বলিলাম। সামাদ ছাহেব এবং আরও কয়েকজন ততক্ষনাত ঔষধটি ক্রয় উদ্দেশ্যে বাহির হইলেন। বিভিন্ন ডিস্পেন্সারী বা ফার্মেসীতে খুঁজিলেন, কিন্তু কোথাও পাইলেন না। ঐ সকল ফার্মেসীর লোকেরা ‘‘কুইনাইন এমন” নামক কোন ঔষধের সন্ধান দিতে পারিলেন না; এমনকি ঐ নামে কোন ঔষধ তৈরী হইয়াছে কিনা, তাহাও তাহারা বলিতে পারিলেন না। কোথাও না পাইয়া আমার মামাতো ভাই বলিলেন, যদি কোন দিন কোথাও এই নামের ঔষধ আবিস্কার হয়, তবে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের গবেষণা বিভাগের ল্যাবরেটরীতে তাহার স্যাম্পল পাওয়া যাইবে।” জনাব সামাদ ছাহেব তাহার স্টাফসহ সকাল ১০টা হইতে বেলা ৩ টা পর্যন্ত ল্যাবরেটরী তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ‘‘কুইনাইন এমন” নামক কোন ঔষধ পাইলেন না। বেলা তিনটার সময় তিনি ভাবিলেন, ‘‘আবার খুঁজিয়া দেখা যাক।” এই চিন্তা করিয়া ল্যাবরেটরীর নীচ তলায় একটি কক্ষে আসিয়া একটি কাঠের বাক্স লক্ষ্য করিলেন। তিনি তদীয় সহকারীকে বলিলেন, দেখতো, এই বাক্সের মধ্যে কি আছে? সহকারী বলিল, এই বাক্সে কেবল দুই তিন দিন হইল ঔষধ রাখা হইয়াছে। সবই নূতন ঔষধ। একবার দেখাও হইয়াছে। সামাদ ছাহেব বলিলেন, আবার খুলিয়া দেখ। সেই বাক্স খুলিয়া দেখা গেল, একটি বড় বোতলের আড়ালে ছোট্ট একটি শিশি। শিশির গায়ে লেখা, ‘‘কুইনাইন এমন।” সামাদ ছাহেবতো যারপরনাই খুশী হইলেন। ঔষধ লইয়া বাসায় আসিলেন। সেই শিশির এক ফোটা ঔষধ খাইয়া আমি পূর্ণ সুস্থ হইলাম। শিসিতে ৭০ ফোটা ঔষধ ছিল। বাকী ৬৯ জন রোগীকে বিভিন্ন রোগের জন্য ৬৯ ফোটা ঔষধ দিয়াছিলাম। তাহারা সকলেই সুস্থ হইয়াছিল।

উল্লিখিত স্বপ্নের বৃত্তান্ত এবং ‘কুইনাইন এমন’ ঔষধ প্রাপ্তি এবং ইহার সেবনের কার্যকরী ফলাফলের পর হইতেই হায়াত খান লেনের সকলেই আমাকে একটু ভিন্ন নজরে দেখিতেন। এই ঘটনার পর পরই জনাব মহসীন খান ছাহেবের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়। তিনিও আমার পীর কেবলাজানের দীক্ষা গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে পীর কেবলাজানের নির্দেশে আমার মিঞা ভাই হযরত মাওলানা আলতাফ হোসেন (রঃ) ছাহেবের কন্যাকে জনাব মহসীন খান ছাহেবের সাথে বিবাহ দেই। অতঃপর পীর কেবলার পরবর্তী এক নির্দেশে মহসীন খান ছাহেবের ভাইয়ের কন্যাকে আমি বিবাহ করি। এমনিভাবে আটরশিতে জনাব মহসীন খান ছাহেবের সহিত আমার আত্বীয়তার সম্পর্কও গড়িয়া উঠে। ইহাই ছিল আমার আটরশি আসিবার সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, পীর কেবলাজান শত সহস্র পরীক্ষা নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া এই মিছকীনকে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞানের যোগ্য বলিয়া মনে করেন এবং আধ্যাত্মিক নেয়ামতে পরিপূর্ণ ডালা মাথায় দিয়া এই অজ পাড়াগাঁ আটরশিতে পাঠাইয়া দেন সত্য তরিকা, সত্য ইসলাম প্রচারের জন্য। কেবলাজান হুজুরের নির্দেশে বাংলা ১৩৫৪ সন হইতে এই আটরশি হইতে সত্য তরিকা প্রচার কাজ শুরু করি। জনাব মহসিন খান ছাহেবের অতি ক্ষুদ্র একটি ছনের ঘর ছিল-যে ঘরে তিনি একটি বকনা বাছুর পালিতেন। আমি তরিকা প্রচারের স্বার্থে তাহার নিকট সেই ঘরটি চাইলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাহা আমাকে প্রদান করেন। সেই ক্ষুদ্র ঘর হইতে তরিকা প্রচারের কর্মসূচী শুরু হয়।

প্রতি সপ্তাহে একটি করিয়া জলসা করিতাম। উপস্থিত খোদাঅন্বেষীদের তালিম দিতাম, সবক দিতাম। আল্লাহ ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহব্বতপূর্ণ ওয়াজ নসিহত শ্রবণে সকলেই অশ্রুপাত করিত। প্রত্যেকটি জলসাতেই প্রচুর ফয়েয ওয়ারেদ হইত। ৮ রশি, সাড়ে ৭ রশি, ১৪ রশি, আড়াই রশি, ব্রাহ্মণদ্বী প্রভৃতি এলাকার জাকেরান ও আশেকানসকল মুষ্ঠি চাউল দিত। ততকালীন সময়ে গরুও খুব সস্তা ছিল। ৩/৪ টাকায় মাঝারী আকৃতির গরু পাওয়া যাইত। জাকেরানদের দেওয়া মুষ্ঠি দ্বারা সাপ্তাহিক জলসা সম্পন্ন করিতাম। ধীরে ধীরে হেদায়েতের কলেবর বৃদ্ধি পায়। খোদাতালাশীদের ভীড় জমে। ফলে এক বছর অন্তে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মাত্র আট (৮) টাকার বিনিময়ে একটি কুড়ে ঘর ক্রয় করি। কুড়ে ঘরটির নাম দেওয়া হয় ‘‘জাকের ক্যাম্প”। সময়ের বিবর্তনে, কালের ব্যবধানে সেই জাকের ক্যাম্প বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে পরিণত হইয়াছে।।

‘জাকের ক্যাম্প’ হইতে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল-ইহা এক বিরাট ইতিহাস। প্রথমে আমি যেদিন আটরশিতে আসি-সেইদিন ছিল কোরবানীর ঈদের দিন। আমি দেখিলাম, সেই ঈদের দিনে লোকজন লাঙ্গল-জোয়াল লইয়া মাঠে যাইতেছে। এখানে নামাজ ছিল না-সমাজ ছিল না। ধনী, মানী, জ্ঞানী, গুণী লোক ছিল না। গরু কোরবানী হইতো না। গরুর গোস্তকে এই এলাকার মোসলমানেরা অস্পৃশ্য মনে করিত। ইসলাম কি-তাহারা জানিত না। পার্শ্বেই ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ী। এই এলাকার মোসলমানগণ জমিদার বাড়ীর পূজায় অংশ গ্রহণ করিত; পূজার প্রসাদ খাইত। তাহারা হিন্দুয়ানী রীতিকে ভালবাসিত। হিন্দুয়ানী রীতিতেই চলিত। ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ তাহাদের কাছে অপরিচিত ছিল। আমার মনে হয়, আটরশির মত এত নিকৃষ্ট গ্রাম বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি ছিল না।

সেই ঈদের দিনে জনাব মহসীন উদ্দিন খান ও তদীয় অপর দুই ভাইকে লইয়া পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করিয়া খোদাতায়ালার নিকট এই দু’আ করিলাম, ‘‘হে খোদাতায়ালা! এই যে তিন/চার জন আমরা ঈদের নামাজ পড়িলাম। দয়া করিয়া তুমি এখানে বিশাল ঈদের জামাত কায়েম কর।” মহান খোদাতায়ালার দয়ায় আজ এখানে বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
যাই হোক, ১৩৫৪ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘জাকের ক্যাম্প’ হইতে ধুমধামে তরিকা প্রচারের কাজ চলিতে থাকে। ক্যাম্পের ছাউনী ছিল ছনের এবং বেড়া বা বেষ্টনী ছিল সুপারী গাছের খোলের। আমার এক পুরাতন মুরীদ, নাম কালু লস্কর। সেই আমাকে সুপারী গাছের খোল সরবরাহ করিত।

ধীরে ধীরে আগন্তকদের ভিড় বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যাম্পের ক্ষেত্রও বাড়াইতে হয়। প্রথমে নিকটস্থ এলাকা থেকে, ততপর পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন, থানা, জেলা থেকে, এমনকি দেশের সর্বত্র থেকে দলে দলে মানুষ আসা শুরু করে। তাহাদেরকে তরিকা দিতাম, খোদাপ্রাপ্তির তালিম দিতাম। এই ভাবে প্রচার কার্য দ্রুত গতিতে চলিতে থাকে। প্রথমে প্রচারকেন্দ্র হিসাবে ক্যাম্প ছিল ছনের তৈরী ঘর-যাহার বেড়া ছিল সুপারী খোলের। কয়েক বছরের ব্যবধানে ছনের তৈরী ক্যাম্পের জায়গা দখল করে টিনের তৈরী ঘর এবং বেড়াও দেওয়া হয় টিন দ্বারা। তখন ক্যাম্পের নাম দেওয়া হয় ‘‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল।”
এরই মধ্যে হেদায়েতের নূর পৌঁছায় দেশে-বিদেশে সর্বত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ আসা শুরু করে; আসে বিদেশ থেকেও। ফলে জাকের মঞ্জিলের কলেবর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং টিনের ঘরের জায়গায় তৈরী হয় বড় বড় অট্টালিকা।

আজকের বহু হর্ম্যরাজিতে বা অট্রালিকায় সুসজ্জিত প্রাণমুখর এই বিশ্ব জাকের মঞ্জিল দেখিতে অনেকটা শহরের মত। ইহার ক্ষেত্র যে কত বড় হইবে তাহা আল্লাহপাকই জানেন।
আজকে এখানে খোদাঅনেষীরা আসে। আসে দলে দলে। হাজারে হাজারে। বছরের বিভিন্ন সময়ে জলসায় যোগ দেয় লাখে লাখে। আগত খোদাতালাসীরা প্রাণ ভরিয়া খোদাতায়ালাকে ডাকে, মহাধুমধামে জেকের করে, আল্লাহ-রাসূলের মহব্বত দেলে পয়দা করে। যাবার সময় মহব্বতের নিদর্শন স্বরূপ চোখে পানি এবং দেলে অনাবিল শান্তির অনুভূতি লইয়া যায়। এই মঞ্জিল বিশ্ব মানবের শান্তির জন্য। কল্যাণের জন্য।

এখানে যাহা কিছু হয়, সবই পাক কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক। শরীয়তের খেলাফ কিছুই নাই এখানে। নিশির শেষ যাম অর্থাত রাত ৩টা হইতে পরবর্তী দিনগত রাত ১১ টা পর্যন্ত চলে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের তালিম। কিন্তু আমার দীর্ঘ জীবনের এই প্রচার কার্য নিষ্কন্টক ছিল না। ছিল শত বাধা, শত বিরোধ। ছিল সত্য তরিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং এই তরিকা প্রচারক হিসাবে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার। স্থূল দৃষ্টি সম্পন্ন আলেম ওলামা ও তথাকথিত পীরেরা যুক্তফ্রন্ট করিয়া, সভা-সমিতি সিম্পোজিয়াম করিয়া আমাকে কাফের ফতোয়া দিল। কত লিফলেট, বিজ্ঞাপন ছাড়িল। কিন্তু সত্য প্রচারে আমি ছিলাম অবিচল। ফলে, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় সত্যেরই জয় হইল। আজ আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপিয়া মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে। তাই মানুষ আসে দলে দলে, সত্যের অমৃত শরাব পানের নেশায়।

সূত্রঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পরিচালনা পদ্ধতি। নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, পৃষ্ঠা নং ১১৩৩ -১১৩৮ 

 

আরো পড়ুনঃ

 

ব্লগটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য

Discover more from Sufibad.Com - সূফীবাদ.কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

আটরশি পীরের জীবনী

আপডেট সময় : ১০:৪৩:৫৮ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৩ মার্চ ২০২৪

আটরশি পীরের জীবনী

আটরশি পীরের সংক্ষিপ্ত পরিচয়: ফরিদপুর জেলার সদরপুর থানা, আটরশি গ্রামে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল অবস্থিত। যার প্রতিষ্ঠাতা শাহসুফী খাজা হাশমত উল্লাহ (রহ:)। তিনি বিশ্ব ওলি খাজাবাবা ফরিদপুরী নামেই বেশি পরিচিত। যিনি খাজা এনায়েতপুরী (শাহসুফী মুহাম্মদ ইউনুস আলী এনায়েতপুরী রহ:)’র মুরিদ ও খলীফা। জনাব খাজা হাশমত উল্লাহ ফরিদপুরী (রহ:) সাহেব জামালপুর জেলার শেরপুর থানার পাকুরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।

দশ বৎসর বয়সে তিনার পিতা শাহ আলীমউদ্দীন সাহেব তিনাকে খাজা এনায়েতপুরীর হাতে অর্পণ করেন। ত্রিশ বৎসর তিনি এনায়েতপুরীর কাছে থেকে কঠর পরিশ্রমের মাধ্যমে সাধনা লাভ করেন। অতপর এনায়েতপুরীর নির্দেশে তিনি ফরিদপুর এসে “জাকের ক্যাম্প” প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তিকালে এটার নাম দেওয়া হয় “বিশ্ব জাকের মঞ্জিল”। সমগ্র বাংলাদেশে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের তুলনা হয় এ রকম অন্য কোন ধর্মীয় কমপ্লেক্স অন্য কোথাও দৃষ্টিগোচর হয়নি। ফলে উক্ত জাকের মঞ্জিলে যেমনি কোটি কোটি ভক্ত মুরীদ রয়েছে, তেমনি সমালোচকের সংখ্যাও কম নয়।

 

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পটভূমি এবং আমার জীবনের দু’টি কথাঃ-

 

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম :

বিশ্ব জাকের মঞ্জিল আল্লাহ ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহা দান, বিশ্ব মানবের জন্য খোদাপ্রাপ্তির প্লাটফর্ম, আধ্যাত্মিক শিক্ষাকেন্দ্র। দেশের সর্বত্র থেকে এখানে মানুষ আসে। আসে আত্মোপলব্ধির তাড়নায়, আসে নিজেকে চিনিবার জন্য, আসে খোদাতায়ালাকে চিনিতে, জানিতে বা বুঝিতে। আজ শুধু দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকেই নয়; পৃথিবীর সর্বত্র থেকেই লোক আসে। তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর মহব্বত অর্জনের জন্য, আসে আল্লাহ ও তদীয় রাসূল (সাঃ) এর শাশ্বত প্রেমের শরাব পানের জন্য।

বিশ্ব জাকের মঞ্জিল জাতির জন্য এক গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এখানের সমস্তই মানব কল্যাণের জন্য। এই বহুমুখী প্রতিষ্ঠানে আছে আলীয়া মাদ্রাসা, সোনালী ব্যাংকের শাখা, পোষ্ট অফিস, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ, আছে ৬০০ শয্যাবিশিষ্ট(প্রস্তাবিত) একটি হাসপাতাল (নির্মাণাধীন); আছে সম্পূর্ণ পাথর নির্মিত দ্বিতল একটি মসজিদ (নির্মাণাধীন) ইহা ছাড়াও জাকেরানদের থাকিবার জন্য আছে বহু অট্টালিকা।

মাদ্রাসার ছাত্রদের ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে প্রতিদিন শত শত, হাজার হাজার তালেবে মাওলাগণ আসে। তাহাদেরকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়-শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাত তথা পূর্ণাংগ ইসলাম সম্পর্কে। দিবা-নিশি ২৪ ঘন্টা চলে এই প্রশিক্ষণ কর্ম। যাহারা জাগতিক সমস্যা লইয়া আসে, সেই সমস্যা সমাধানের উপদেশ দানের মাধ্যমেই আমি তাহাদেরকে আধ্যাত্মিকতা শিক্ষা দেই; খোদাতায়ালার দিকে পথ দেখাই। তাহাদের প্রত্যেকের জিহ্বাতেই এক ফোটা করিয়া আধ্যাত্মিক মধু প্রদান করি; যে অমীয় মধুর মিষ্টি স্বাদে ও আকর্ষণে পুনঃপুনঃ তাহারা আসে আল্লাহ ও রাসূল (সাঃ) এর এই দরবারে, আরও অধিক মধু পানের অতৃপ্ত তৃষ্ণায়।

কাহার সাধ্য এই বিশাল মেহমানখানা পরিচালনা করে? প্রতিদিন কত লোক আসিবে, কত মেহমানকে খাবার পরিবেশন করা হইবে- তাহার হিসাব নাই। এত লোকের এক সন্ধ্যার তরকারীও কোন উপশহরে মিলে না। অথচ যখনই যত মেহমান আসে, তাহাদের সকলেরই খাবারের ব্যবস্থা থাকে। অত্যন্ত নিয়ম শৃংখলার সাথে চলে এই মেহমানখানা।
এই দরবার এমনই এক দরবার, যেখানে সুখের খানা খাওয়াইয়া, আরামের বিছানায় শোয়াইয়া খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বের তালিম দেওয়া হয়। শুধু খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্ব সম্পর্কেই নয়; তালিম (শিক্ষা) চলে পরিপূর্ণ সত্য ইসলামের উপরে, সত্য তরিকার উপরে; প্রশিক্ষণ চলে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের উপরে; দিন-রাত্রি ২৪ ঘন্টা ব্যাপিয়াই।

এই বিশাল মেহমানখানা পরিচালনা, দিবা-নিশি তালিম বা প্রশিক্ষণ দান; সুষ্ঠু ও সুশৃংখল ব্যবস্থাপনা, ইহার সবই সম্ভব হয়-কারণ এই দরবার আল্লাহ ও রাসূলের স্বীকৃত দরবার; ইহার পরিচালনার দায়িত্ব আমার পীর কেবলাজান হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের উপরে; আমি তাঁহার পক্ষ হইতে একজন তত্ত্বাবধায়ক মাত্র।
আজকের এই শান-শওকতময় ও প্রাণমূখর বিশ্ব জাকের মঞ্জিল একদিনে গড়িয়া উঠে নাই। ইহার পিছনে আছে এই মিসকিনের দীর্ঘ ৪৫ বছরের প্রচার জীবন। আছে বিরোধী ব্যক্তি, গোষ্ঠী বা শক্তির মোকাবেলা। ইহা ব্যতীতও আছে আটরশিতে আসিবার পূর্বে পীরের কদমে প্রায় দীর্ঘ ৪০ বছরের অপরিসীম ত্যাগ-তিতিক্ষা, অনাহার-অনিদ্রা, সুকঠিন ব্রত, অতিশয় শ্রম, চরম দরিদ্রতা ও কঠোর রেয়াযতের পরীক্ষা উত্তরণ।
বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পটভূমিকা বিশ্লেষণে, ইতিহাস বর্ণনে আমার জীবনের কিঞ্চিত বিবরণ প্রয়োজন বলিয়া মনে হয়। আমার বয়স তখন সাত কিংবা আট। সেই কৈশোর বয়সে আমার পীর, জামানার নূর, শতাব্দির মুজাদ্দেদ, হযরত খাজাবাবা এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেব একবার আমাদের শেরপুরের পাকুরিয়াস্থ গ্রামের বাড়ীতে তশরিফ রাখিয়াছিলেন। তিনি প্রথমে উঠেন তদীয় এক মুরীদ নইমুদ্দিন মুনসী ছাহেবের বাড়ীতে। নইমুদ্দিন মুন্সী ছাহেবের সাথে আলাপকালে তিনি তাহাকে বলেন, ‘‘তোমাদের গ্রামের ছর্দারকে ডাকিয়া আন।” আমার আব্বাজান জনাব আলীমুদ্দিন ছাহেব মুজাদ্দেদী ছিলেন অত্র এলাকার সর্বাধিক শ্রদ্ধাভাজন ব্যক্তিত্ব। নইমুদ্দিন মুন্সী ছাহেব আমার আব্বাজানকে ডাকিয়া আনিলেন। পীর কেবলাজানের সাথে আব্বাজানের বহু সময় আলাপ আলোচনা হইল। আব্বাজান হুজুর পীর কেবলাজানের অমায়িক ব্যবহার ও উপদেশে মুগ্ধ হইলেন এবং আমাদের বাড়ীতে তদীয় কদম মোবারক রাখিবার জন্য অনুনয়-বিনয় করিলেন। কেবলাজান হুজুর রাজী হইলেন; আমাদের বাড়ীতে তশরীফ রাখিলেন। তাহার দীপ্তময় চেহারা দর্শনে আমি সেদিন মুগ্ধ হইয়াছিলাম। আমার মনে হইতেছিল, আসমান হইতে যেন দলে দলে ফেরেশতারা আমাদের বাড়ীতে অবতরণ করিতেছে; যেন এক স্বর্গীয় পরিবেশ-যাহা কোনদিনই ভুলিবার নয়। বহু আলাপ আলোচনার মধ্যেই পীর কেবলাজান আমাকে এবং আমার বড় ভাই মাওলানা আলতাফ হোসেন (রঃ) এর দিকে ইশারা করিয়া আব্বাজানকে বলিলেন, ‘‘বাবা, আপনার ঐ দুইটি ছেলে আমাকে দেন।” আব্বাজান হুজুর দ্বিরুক্তি না করিয়া ততক্ষনাত আমাকে এবং আমার বড় ভাই মাওলানা আলতাফ হোসেন ছাহেবকে পীর কেবলার পাক কদমে সোপর্দ করিলেন।” দেওয়া নেওয়ার পর্ব শেষ হইল। সেই দিন হইতে আমি আমার পীর কেবলাজান হযরত এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের। সেই একবারই পীর কেবলাজান শেরপুরের অজপাড়াগাঁ পাকুরিয়ায় তশরিফ রাখিয়াছিলেন; আর কখনও যান নাই। জামালপুরের বগাইদ নিবাসী মাওলানা নইমুদ্দিন ছাহেব নামক এক ব্যক্তি পীর কেবলাজান ছাহেবের অতি মহব্বতের মুরীদ ছিলেন। কেবলাজান হুজুরকে তিনি নিজের চেয়েও বেশী মহব্বত করিতেন। সব সময়ই জজবা হালাতে থাকিতেন। তিনি বাতেনী জ্ঞানসম্পন্ন মজ্জুব পাগল ছিলেন। যাহা বলিতেন, তাহা সত্য হইত। আমি এবং আমার বড় ভাই হযরত মাওলানা আলতাফ হোসেন মাঝে মাঝে তাহার নিকট যাইতাম। আমাদেরকে তিনি অতিশয় মহব্বত করিতেন। কিন্তু কেন এত ভালবাসিতেন, তাহা বুঝিতাম না। পীর কেবলাজান আমাদের বাড়ীতে তশরিফ রাখিয়াছিলেন, হয়তো সেই কারণে হইবে। তিনিই একদিন আমাদেরকে বলিলেন, ‘‘হযরত পীর কেবলাজান হুজুর যে একবার মাত্র শেরপুরের অজ পাড়াগাঁ পাকুরিয়া আসিয়াছিল, তাহা শুধুমাত্র আপনাদের দুই ভাইকে নেওয়ার জন্য।”

ইহার দুই বছর পরের কথা। আমার বয়স তখন দশ। সেই দশ বছর বয়সে আব্বাজানের সাথে আমি আমার পীর কেবলাজান, যামানার মুজাদ্দেদ, হযরত খাজাবাবা শাহসূফী এনায়েতপুরী (কুঃ) ছাহেবের এনায়েতপুরস্থ দরবার শরীফে যাই। সেই হইতে শুরু হয় খোদাপ্রাপ্তির কঠোর সাধনা ও নিরবচ্ছিন্ন রেয়াযত। খোদাপ্রাপ্তির পথ বড় কন্টকাকীর্ণ। এই পথে অসংখ্য পরীক্ষা দিতে হয়। কঠোর শ্রমের পরীক্ষা, দরিদ্রতার পরীক্ষা, অনাহার-অনিদ্রার পরীক্ষা, অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষা। কঠিন পরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই না করিয়া খোদাতায়ালা কাহাকেও নিজ দরবারে প্রবেশের যোগ্যতার সার্টিফিকেট প্রদান করেন না। প্রত্যেক সাধককেই পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষা দিয়াছেন নবী-রাসূলগণ। পরীক্ষা দিয়াছেন বিগত দিনের ওলীয়ে কামেল সকল। খোদাপ্রাপ্তির এই রাস্তায় এই মিসকিনকেও কম পরীক্ষা দিতে হয় নাই। দীর্ঘ ৪০ বছর পীরের কদমে অনাহার-অনিদ্রাসহ অমানুষিক শ্রম ও অপরিসীম ত্যাগের পরীক্ষা দিতে হইয়াছে। পীর কেবলাজান আমাকে তেমন খাইতে দিতেন না। অর্ধচামচ ভাত-ততসংগে যতকিঞ্চিত তরকারী আমাকে দিতেন। অধিকাংশ দিনে একবার; কখনও বা দুইবার দিতেন। অবশ্য অন্যান্য সকলকেই পেট ভরিয়া দিনে দুইবার খাবার দিতেন। খাদ্য কম দেওয়া যেন শুধু আমার জন্যই নির্ধারিত ছিল। অথচ পরিশ্রম আমাকেই সকলের চেয়ে বেশী করিতে হইত। খাদ্য কম, কাজ বেশী। আমার শরীর যেন নিস্তেজ হইয়া আসিত। ক্ষুধা পেটে,দুর্বল শরীরেই আমাকে মাটি কাটিতে হইত, ছয় মাইল দূরের খুকনী হইতে টুকরী ভর্তি বাসন আনিতে হইত। ইহা ছাড়াও যমুনা নদীর তীরে স্থলচর ঘাট হইতে গরুর গাড়ীতে তুলিয়া ধান, চাউল বা ডাউল আনিতে হইত। এমনিভাবে কঠোর খেদমত করিতে হইত। একদিন পীর কেবলাজান আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, তুমি যদি খোদাতায়ালাকে পাইতে চাও, তবে ত্যাগী হও।” বিদায় লইয়া বাড়ীতে গিয়া আব্বাজানকে পীর কেবলাজানের উক্ত উপদেশের কথা বলিলে তিনি আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, বড়ই কঠোর হুকুম। তোমাকে সর্বস্ব ত্যাগ করিতে হইবে।” অতঃপর আমি আমার সমুদয় জমি-জমা, সহায়-সম্পদ বিক্রয় করিয়া প্রাপ্ত টাকা কেবলাজান হুজুরের কদমে নজরানা দিয়া একেবারেই কপর্দকশূন্য মিছকীন হইলাম। কেবলাজানের কদমে নিরলস খেদমত করিতে থাকিলাম।

আত্বীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব একে একে সবাই আমাকে ত্যাগ করিল। আমার আর আপন বলিয়া কেহই রহিল না। এমনই সে অবস্থা যেন, উড়িবার পাখা নাই; ধরিবার ডাল নাই। একমাত্র অবলম্বন ছিলেন আমার পীর কেবলাজান। সর্বস্বান্ত অবস্থায় পীরের দরবারে অনাহার-অনিদ্রাসহ কঠোর খেদমত চলে জীবনের চল্লিশটি বছর। এই দীর্ঘ সময়ে তিনি হাতে-কলমে এই মিছকিনকে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের তালিম দেন; নিজ হাতে মনের মত করিয়া গড়িয়া তোলেন। অবশেষে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান-যাহা রাসূলে পাক (সাঃ) হইতে সিনা-ব-সিনা তদীয় পবিত্র দেলে সংরক্ষিত ছিল, তাহা এই মিছকীনের কালবে প্রদানপূর্বক হেদায়েতের দায়িত্বভার অর্পণ করেন, সত্যপথচ্যুত আল্লাহভোলা মানুষদেরকে সত্যের দিকে আহবানের নির্দেশ দেন। আমি পীরের নির্দেশে এই আটরশি হইতেই সত্য তরিকা বা খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞান প্রচার শুরু করি। এই আটরশিতে আসিবার ইতিহাসও অনেক গভীরে। পীর কেবলাজানের কদমে খেদমতরত অবস্থায় তিনি আমাকে প্রায়শঃই কোলকাতায় যাওয়ার নির্দেশ দিতেন। বলিতেন, ‘‘কোলকাতায় যাও, চাকুরী খোঁজ।” পীরের নির্দেশ, তাই কোলকাতায় যাইতাম। কিন্তু আমিতো ছিলাম কপর্দকশূন্য। তাই ক্ষুধাপেটে, কোলকাতার রাস্তায় রাস্তায় ঘুরিয়া বেড়াইতাম। কে দিবে আমাকে চাকুরী? কে দিবে আমাকে খাবার? ফলে দরবারে ফিরিয়া আসিতাম। পুনরায় কেবলাজান হুজুর কোলকাতায় যাওয়ার আদেশ করিতেন। আবার কোলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতাম। এমনিভাবে বহুবার আমি কোলকাতায় গিয়াছি। মূলতঃ এই আটরশিতে আসিবার লাইনটাই ছিল কোলকাতায়।

কোলকাতায় আমি আমার মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবের বাসায় অবস্থান করিতাম। তিনি ৬ নং হায়াত খান লেনে থাকিতেন। ঐ বাসাতে আমার মামাতো ভাইয়ের সাথে আরও দুইজন থাকিতেন। তাহাদের একজন হইলেন জনাব মহসীনউদ্দিন খান ছাহেব; অপরজন হইলেন সিরাজ ছাহেব। সিরাজ ছাহেব কলিকাতার নিকটে ‘‘কাশীপুর গান এন্ড শেল ফ্যাক্টরী”তে চাকুরী করিতেন। আমার মামাতো ভাই সামাদ ছাহেব কলিকাতা মেডিক্যাল কলেজের গবেষণা বিভাগে চাকুরী করিতেন। জনাব মহসীন খান ছাহেবের বাড়ী এই আটরশিতেই।

মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবের বাসায় অবস্থান কালে আমি এক তাতপর্যবহ স্বপ্ন দেখিয়াছিলাম। স্বপ্নে আমি শুনিলাম, লোকে বলাবলি করিতেছে, রাসূলে পাক (সাঃ) কলিকাতা শহরে আগমন করিতেছেন। আরও শুনিলাম, তিনি কলিকাতার সার্কুলার রোডে আসিতেছেন। সৃষ্টির সেরা মানব,রাহমাতুল্লিল আ’লামীনকে দেখিবার বাসনা কাহার না থাকে?তাহাকে এক নজর দেখিবার জন্য লক্ষ লক্ষ আশেকে রাসূলের ভিড় পড়িল। সার্কুলার রোডের এক পার্শ্বে আমিও গিয়া দাঁড়াইলাম দয়াল নবী (সাঃ) কে এক নজর দেখিবার তৃষ্ণায়। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখিলাম, অতীব চমতকার, নূতন মডেলের একটি মোটরযানে রাসূলে পাক (সাঃ) আসিতেছেন। এমন উন্নত মডেল ও ডিজাইনের গাড়ী কোলকাতার রাস্তায় ইতিপূর্বে আমি দেখি নাই। সকলেই রাসূলে পাক (সাঃ) এর পবিত্র বদনের দিকে অপলক নেত্রে তাকাইয়া রহিয়াছে। দেখিতে দেখিতে মোটর গাড়ীটি আমার নিকট পর্যন্ত আসিয়া থামিয়া গেল। দয়াল নবী (সাঃ) আমাকে হাতের ইশারায় ডাক দিলেন। আমি নিকটে উপস্থিত হওয়া মাত্রই তিনি বলিলেন, ‘‘বাবা, তোমার উপর গযব আসিতেছে; তুমি তওবা কর।” আমি দয়াল নবী রাসূলে পাক (সাঃ) এর কদম ধরিয়া মহান খোদাতায়ালার নিকট তওবা করিলাম। বলিলাম, হে খোদা! আমি যত গোনাহ করিয়াছি, যত মনে আছে, যত ভুলিয়া গিয়াছি-সমস্ত গোনাহ হইতে তোমার নিকট দয়াল নবী (সাঃ)-এর অছিলায় তওবা করিতেছি। দয়া করিয়া তুমি আমাকে মাফ কর। রাসূলে পাক (সাঃ) বলিলেন, ‘‘আল্লাহ তোমাকে মাফ করিয়া দিয়াছেন। গজবও তুলিয়া নিয়াছেন। তবে গজবের সামান্য একটু যাহা দুনিয়াতে আসিয়া পড়িয়াছে-তাহা তোমাকে ভোগ করিতে হইবে।” নিশির শেষ ভাগ বা রহমতের সময় এই স্বপ্ন আমি দেখিলাম। আমার ঘুম ভাংগিয়া গেল। মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবকে স্বপ্নের বৃত্তান্ত বলিলাম। এই সময় জনাব মহসীন উদ্দিন খান ছাহেবও জাগ্রত ছিলেন। তিনি স্বপ্নের বৃত্তান্ত শুনিলেন। ঐ স্বপ্ন দেখিবার তিন দিনের দিন আমার শরীর খারাপ বোধ হইতে লাগিল। আমি মামাতো ভাইকে বলিলাম। ভাইজান, আমি যদি সংজ্ঞাহীন হই, আমার আব্রু যাহাতে হাটুর উপরে না উঠে; সেই দিকে তুমি একটু খেয়াল রাখিও। জোহরের পর সমস্ত শরীর কালো বর্ণ ধারণ করিল। আসরের সময় কম্প দিয়া জ্বর আসিল। মাগরীবের সময় আমি সংজ্ঞা হারাইয়া ফেলিলাম।
সংজ্ঞাহীন অবস্থায় স্বপ্নে দেখিলাম।

কেবলাজান হুজুর হ্যারিসন রোড হইতে হায়াত খান লেনের দিকে আসিতেছেন। তাঁহার সংগে আছেন জনাব আলিম উদ্দিন সরকার ছাহেব। তিনি পীর কেবলাজান হুজুরের শ্বশুর ছিলেন। আমরা তাহাকে নানাজান বলিয়া সম্বোধন করিতাম। হযরত কেবলাজান হুজুর ৬ নং হায়াত খান লেনে আসিয়া যে ঘরে আমি শয্যাগত ছিলাম, সেই ঘরে প্রবেশ করিয়া আমার মাথার দিকে বসিলেন। আমি আবেগাব্লুত হইয়া কেবলাজানকে বলিলাম, ‘‘হুজুর, এই কলিকাতা শহরে আমার কে আছে? আমি যদি অসুস্থাবস্থায় এমন পড়িয়া থাকি, কে আমাকে দেখিবে?” পীর কেবলাজান আমাকে বলিলেন, ‘‘বাবা, এই যে আমি তোমাকে দেখিতে আসিয়াছি। আমিতো তোমার নিকটেই আছি। তোমার কোন চিন্তা নাই। তুমি এক ঘন্টার ভিতরেই সুস্থ হইবে। তিনি আরও বলিলেন, ‘‘কুইনাইন এমন” নামক একটি ঔষুধ আছে। উহার একটি ফোটা তুমি সেবন করিও। ইহাতে তুমি পূর্ণ সুস্থ হইবে। এই অর্থপূর্ণ স্বপ্ন দেখিবার পরক্ষণেই আমার সংজ্ঞাহীন ভাব কাটিয়া গেল। চক্ষু মেলিয়া দেখি, হায়াত খান লেনের বাসার সকলেই আমার শিয়রে দন্ডায়মান। দেখিলাম, সকলেই চিন্তিত, উতকন্ঠিত।

‘কুইনাইন এমন’ নামক যে ঔষুধের কথা স্বপ্নে পীর কেবলাজান ছাহেব আমাকে বলিয়াছিলেন, আমি মামাতো ভাই সামাদ ছাহেবকে তাহা অনতিবিলম্বে সংগ্রহ করিতে বলিলাম। সামাদ ছাহেব এবং আরও কয়েকজন ততক্ষনাত ঔষধটি ক্রয় উদ্দেশ্যে বাহির হইলেন। বিভিন্ন ডিস্পেন্সারী বা ফার্মেসীতে খুঁজিলেন, কিন্তু কোথাও পাইলেন না। ঐ সকল ফার্মেসীর লোকেরা ‘‘কুইনাইন এমন” নামক কোন ঔষধের সন্ধান দিতে পারিলেন না; এমনকি ঐ নামে কোন ঔষধ তৈরী হইয়াছে কিনা, তাহাও তাহারা বলিতে পারিলেন না। কোথাও না পাইয়া আমার মামাতো ভাই বলিলেন, যদি কোন দিন কোথাও এই নামের ঔষধ আবিস্কার হয়, তবে কলিকাতা মেডিকেল কলেজের গবেষণা বিভাগের ল্যাবরেটরীতে তাহার স্যাম্পল পাওয়া যাইবে।” জনাব সামাদ ছাহেব তাহার স্টাফসহ সকাল ১০টা হইতে বেলা ৩ টা পর্যন্ত ল্যাবরেটরী তন্ন তন্ন করিয়া খুঁজিয়াও ‘‘কুইনাইন এমন” নামক কোন ঔষধ পাইলেন না। বেলা তিনটার সময় তিনি ভাবিলেন, ‘‘আবার খুঁজিয়া দেখা যাক।” এই চিন্তা করিয়া ল্যাবরেটরীর নীচ তলায় একটি কক্ষে আসিয়া একটি কাঠের বাক্স লক্ষ্য করিলেন। তিনি তদীয় সহকারীকে বলিলেন, দেখতো, এই বাক্সের মধ্যে কি আছে? সহকারী বলিল, এই বাক্সে কেবল দুই তিন দিন হইল ঔষধ রাখা হইয়াছে। সবই নূতন ঔষধ। একবার দেখাও হইয়াছে। সামাদ ছাহেব বলিলেন, আবার খুলিয়া দেখ। সেই বাক্স খুলিয়া দেখা গেল, একটি বড় বোতলের আড়ালে ছোট্ট একটি শিশি। শিশির গায়ে লেখা, ‘‘কুইনাইন এমন।” সামাদ ছাহেবতো যারপরনাই খুশী হইলেন। ঔষধ লইয়া বাসায় আসিলেন। সেই শিশির এক ফোটা ঔষধ খাইয়া আমি পূর্ণ সুস্থ হইলাম। শিসিতে ৭০ ফোটা ঔষধ ছিল। বাকী ৬৯ জন রোগীকে বিভিন্ন রোগের জন্য ৬৯ ফোটা ঔষধ দিয়াছিলাম। তাহারা সকলেই সুস্থ হইয়াছিল।

উল্লিখিত স্বপ্নের বৃত্তান্ত এবং ‘কুইনাইন এমন’ ঔষধ প্রাপ্তি এবং ইহার সেবনের কার্যকরী ফলাফলের পর হইতেই হায়াত খান লেনের সকলেই আমাকে একটু ভিন্ন নজরে দেখিতেন। এই ঘটনার পর পরই জনাব মহসীন খান ছাহেবের সাথে আমার ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্বের সম্পর্ক দৃঢ়তর হয়। তিনিও আমার পীর কেবলাজানের দীক্ষা গ্রহণ করেন।

পরবর্তীতে পীর কেবলাজানের নির্দেশে আমার মিঞা ভাই হযরত মাওলানা আলতাফ হোসেন (রঃ) ছাহেবের কন্যাকে জনাব মহসীন খান ছাহেবের সাথে বিবাহ দেই। অতঃপর পীর কেবলার পরবর্তী এক নির্দেশে মহসীন খান ছাহেবের ভাইয়ের কন্যাকে আমি বিবাহ করি। এমনিভাবে আটরশিতে জনাব মহসীন খান ছাহেবের সহিত আমার আত্বীয়তার সম্পর্কও গড়িয়া উঠে। ইহাই ছিল আমার আটরশি আসিবার সংক্ষিপ্ত কাহিনী।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, পীর কেবলাজান শত সহস্র পরীক্ষা নিরীক্ষার কষ্টিপাথরে যাচাই করিয়া এই মিছকীনকে খোদাপ্রাপ্তিতত্ত্বজ্ঞানের যোগ্য বলিয়া মনে করেন এবং আধ্যাত্মিক নেয়ামতে পরিপূর্ণ ডালা মাথায় দিয়া এই অজ পাড়াগাঁ আটরশিতে পাঠাইয়া দেন সত্য তরিকা, সত্য ইসলাম প্রচারের জন্য। কেবলাজান হুজুরের নির্দেশে বাংলা ১৩৫৪ সন হইতে এই আটরশি হইতে সত্য তরিকা প্রচার কাজ শুরু করি। জনাব মহসিন খান ছাহেবের অতি ক্ষুদ্র একটি ছনের ঘর ছিল-যে ঘরে তিনি একটি বকনা বাছুর পালিতেন। আমি তরিকা প্রচারের স্বার্থে তাহার নিকট সেই ঘরটি চাইলে তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাহা আমাকে প্রদান করেন। সেই ক্ষুদ্র ঘর হইতে তরিকা প্রচারের কর্মসূচী শুরু হয়।

প্রতি সপ্তাহে একটি করিয়া জলসা করিতাম। উপস্থিত খোদাঅন্বেষীদের তালিম দিতাম, সবক দিতাম। আল্লাহ ও রাসূলে পাক (সাঃ) এর মহব্বতপূর্ণ ওয়াজ নসিহত শ্রবণে সকলেই অশ্রুপাত করিত। প্রত্যেকটি জলসাতেই প্রচুর ফয়েয ওয়ারেদ হইত। ৮ রশি, সাড়ে ৭ রশি, ১৪ রশি, আড়াই রশি, ব্রাহ্মণদ্বী প্রভৃতি এলাকার জাকেরান ও আশেকানসকল মুষ্ঠি চাউল দিত। ততকালীন সময়ে গরুও খুব সস্তা ছিল। ৩/৪ টাকায় মাঝারী আকৃতির গরু পাওয়া যাইত। জাকেরানদের দেওয়া মুষ্ঠি দ্বারা সাপ্তাহিক জলসা সম্পন্ন করিতাম। ধীরে ধীরে হেদায়েতের কলেবর বৃদ্ধি পায়। খোদাতালাশীদের ভীড় জমে। ফলে এক বছর অন্তে পার্শ্ববর্তী গ্রাম হইতে মাত্র আট (৮) টাকার বিনিময়ে একটি কুড়ে ঘর ক্রয় করি। কুড়ে ঘরটির নাম দেওয়া হয় ‘‘জাকের ক্যাম্প”। সময়ের বিবর্তনে, কালের ব্যবধানে সেই জাকের ক্যাম্প বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে পরিণত হইয়াছে।।

‘জাকের ক্যাম্প’ হইতে বিশ্ব জাকের মঞ্জিল-ইহা এক বিরাট ইতিহাস। প্রথমে আমি যেদিন আটরশিতে আসি-সেইদিন ছিল কোরবানীর ঈদের দিন। আমি দেখিলাম, সেই ঈদের দিনে লোকজন লাঙ্গল-জোয়াল লইয়া মাঠে যাইতেছে। এখানে নামাজ ছিল না-সমাজ ছিল না। ধনী, মানী, জ্ঞানী, গুণী লোক ছিল না। গরু কোরবানী হইতো না। গরুর গোস্তকে এই এলাকার মোসলমানেরা অস্পৃশ্য মনে করিত। ইসলাম কি-তাহারা জানিত না। পার্শ্বেই ছিল হিন্দু জমিদারের বাড়ী। এই এলাকার মোসলমানগণ জমিদার বাড়ীর পূজায় অংশ গ্রহণ করিত; পূজার প্রসাদ খাইত। তাহারা হিন্দুয়ানী রীতিকে ভালবাসিত। হিন্দুয়ানী রীতিতেই চলিত। ইসলামী আদর্শ ও মূল্যবোধ তাহাদের কাছে অপরিচিত ছিল। আমার মনে হয়, আটরশির মত এত নিকৃষ্ট গ্রাম বাংলাদেশে আর দ্বিতীয়টি ছিল না।

সেই ঈদের দিনে জনাব মহসীন উদ্দিন খান ও তদীয় অপর দুই ভাইকে লইয়া পবিত্র ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করিয়া খোদাতায়ালার নিকট এই দু’আ করিলাম, ‘‘হে খোদাতায়ালা! এই যে তিন/চার জন আমরা ঈদের নামাজ পড়িলাম। দয়া করিয়া তুমি এখানে বিশাল ঈদের জামাত কায়েম কর।” মহান খোদাতায়ালার দয়ায় আজ এখানে বিশাল ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয়।
যাই হোক, ১৩৫৪ সনে প্রতিষ্ঠিত ‘জাকের ক্যাম্প’ হইতে ধুমধামে তরিকা প্রচারের কাজ চলিতে থাকে। ক্যাম্পের ছাউনী ছিল ছনের এবং বেড়া বা বেষ্টনী ছিল সুপারী গাছের খোলের। আমার এক পুরাতন মুরীদ, নাম কালু লস্কর। সেই আমাকে সুপারী গাছের খোল সরবরাহ করিত।

ধীরে ধীরে আগন্তকদের ভিড় বৃদ্ধি পায়। ফলে ক্যাম্পের ক্ষেত্রও বাড়াইতে হয়। প্রথমে নিকটস্থ এলাকা থেকে, ততপর পাশ্ববর্তী ইউনিয়ন, থানা, জেলা থেকে, এমনকি দেশের সর্বত্র থেকে দলে দলে মানুষ আসা শুরু করে। তাহাদেরকে তরিকা দিতাম, খোদাপ্রাপ্তির তালিম দিতাম। এই ভাবে প্রচার কার্য দ্রুত গতিতে চলিতে থাকে। প্রথমে প্রচারকেন্দ্র হিসাবে ক্যাম্প ছিল ছনের তৈরী ঘর-যাহার বেড়া ছিল সুপারী খোলের। কয়েক বছরের ব্যবধানে ছনের তৈরী ক্যাম্পের জায়গা দখল করে টিনের তৈরী ঘর এবং বেড়াও দেওয়া হয় টিন দ্বারা। তখন ক্যাম্পের নাম দেওয়া হয় ‘‘বিশ্ব জাকের মঞ্জিল।”
এরই মধ্যে হেদায়েতের নূর পৌঁছায় দেশে-বিদেশে সর্বত্র। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হইতে প্রতিদিন হাজারে হাজারে মানুষ আসা শুরু করে; আসে বিদেশ থেকেও। ফলে জাকের মঞ্জিলের কলেবর দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং টিনের ঘরের জায়গায় তৈরী হয় বড় বড় অট্টালিকা।

আজকের বহু হর্ম্যরাজিতে বা অট্রালিকায় সুসজ্জিত প্রাণমুখর এই বিশ্ব জাকের মঞ্জিল দেখিতে অনেকটা শহরের মত। ইহার ক্ষেত্র যে কত বড় হইবে তাহা আল্লাহপাকই জানেন।
আজকে এখানে খোদাঅনেষীরা আসে। আসে দলে দলে। হাজারে হাজারে। বছরের বিভিন্ন সময়ে জলসায় যোগ দেয় লাখে লাখে। আগত খোদাতালাসীরা প্রাণ ভরিয়া খোদাতায়ালাকে ডাকে, মহাধুমধামে জেকের করে, আল্লাহ-রাসূলের মহব্বত দেলে পয়দা করে। যাবার সময় মহব্বতের নিদর্শন স্বরূপ চোখে পানি এবং দেলে অনাবিল শান্তির অনুভূতি লইয়া যায়। এই মঞ্জিল বিশ্ব মানবের শান্তির জন্য। কল্যাণের জন্য।

এখানে যাহা কিছু হয়, সবই পাক কুরআন ও সুন্নাহ ভিত্তিক। শরীয়তের খেলাফ কিছুই নাই এখানে। নিশির শেষ যাম অর্থাত রাত ৩টা হইতে পরবর্তী দিনগত রাত ১১ টা পর্যন্ত চলে শরীয়ত, তরিকত, হকিকত ও মারেফাতের তালিম। কিন্তু আমার দীর্ঘ জীবনের এই প্রচার কার্য নিষ্কন্টক ছিল না। ছিল শত বাধা, শত বিরোধ। ছিল সত্য তরিকার বিরুদ্ধে অপপ্রচার এবং এই তরিকা প্রচারক হিসাবে আমার বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচার। স্থূল দৃষ্টি সম্পন্ন আলেম ওলামা ও তথাকথিত পীরেরা যুক্তফ্রন্ট করিয়া, সভা-সমিতি সিম্পোজিয়াম করিয়া আমাকে কাফের ফতোয়া দিল। কত লিফলেট, বিজ্ঞাপন ছাড়িল। কিন্তু সত্য প্রচারে আমি ছিলাম অবিচল। ফলে, আল্লাহপাকের ইচ্ছায় সত্যেরই জয় হইল। আজ আসমুদ্র হিমাচল ব্যাপিয়া মানুষ সত্যকে উপলব্ধি করিতে পারিয়াছে। তাই মানুষ আসে দলে দলে, সত্যের অমৃত শরাব পানের নেশায়।

সূত্রঃ বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পরিচালনা পদ্ধতি। নসিহত-সকল খন্ড একত্রে, পৃষ্ঠা নং ১১৩৩ -১১৩৮ 

 

আরো পড়ুনঃ