ঢাকা ০৪:১২ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৬ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শাহসূফি খাজা ফরিদপুরী (কুঃ) ছাহেবের নসিহতের আলোকে

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

  • আপডেট সময় : ১১:২৩:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৪
  • / ২৪৬১ বার পড়া হয়েছে
Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনে আবু হাতিম (রঃ) হযরত কাব আহরার (রঃ) হইতে একটি বিস্ময়কর বর্ণনার উল্লেখ করিয়াছেন। তাহা হইলঃ
সপ্তম আকাশে জান্নাতের নিকটতম স্থানে সিদরাতুল মুনতাহা অবস্থিত। উক্ত গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় অসংখ্য ফেরেশতা। এক চুল পরিমান খালিও নাই। ঐ গাছের মাঝামাঝি স্থানে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর আবাস। মোমেন বান্দাগণের প্রতি অতিশয় স্নেহশীল ও মমতার প্রতীক এই সব ফেরেশতাকে লইয়া শবে কদরে ভু-পৃষ্ঠে পদার্পণ করিবার জন্য মহান আল্লাহ হযরত জিব্রাইলকে (আঃ) নির্দেশ দেন। সব ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) এর নেতৃত্বে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং দুনিয়ার সর্বত্র ছড়াইয়া পড়েন। প্রত্যেক স্থানে সেজদা ও রুকু করেন। মোমেন নারী-পুরুষদের জন্য দু’আয় লিপ্ত হন। কিন্তু গির্যা, মন্দির, প্রতিমা ও অগ্নি পূজার স্থান, আবর্জনার স্তূপ, যে গৃহে নেশাখোর, বাদ্যযন্ত্র ও পুতুল প্রতিমা থাকে সেইসব জায়গা হইতে তাঁহারা দূরে সরিয়া থাকেন। এইভাবে সারা রাত্রি তাঁহারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরিয়া বেড়ান এবং মোমেনদের জন্য মঙ্গল কামনা ও কল্যাণের জন্য দু’আ করিতে থাকেন। হযরত জিব্রাইল (আঃ) প্রত্যেক ঈমানদারের সহিত করমর্দন করেন। শরীর রোমাঞ্চিত হওয়া, হৃদয় বিগলিত হওয়া, চোখের পানি গড়াইয়া পড়া ইত্যাদি তাহার করমর্দনের আলামত।

এই অবস্থা অনুভূত হইলে বুঝিতে হইবে যে, এই মুহূর্তে আমার হাত জিব্রাইল (আঃ) এর হাতের ভিতর। হযরত কাব (রঃ) আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি এই রাত্রিতে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়িবে, প্রথম পাঠ করার বদৌলতে তাহাকে ক্ষমা করা হইবে, দ্বিতীয়বার পড়ার জন্যে সে দোযখ হইতে নিষ্কৃতি পাইবে, তৃতীয়বার উচ্চারণের ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করিবে। রাবী কর্তৃক তিনি জিজ্ঞাসিত হইলেন, হে আবু ইসহাক! যে ব্যক্তি এই কলেমাকে নিষ্ঠার সহিত বলিবে, কেবল তাহারই জন্য কি এই ফযিলত? তিনি বলিলেন, কেবল নিষ্ঠাবান সত্যবাদী ব্যক্তিই এই কলেমা পাঠ করিবে। আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি, পিঠে পাহাড় উঠাইয়া দিলে যেইরূপ ভারী মনে হয়, মুনাফেক ও কাফেরের পক্ষেও শবে কদর সেই রূপ ভারী মনে হইবে। ফজর পর্যন্ত ফেরেশতারা এই রূপে অবস্থান করেন। অতঃপর আসমানে প্রথম আরোহণ করেন হযরত জিব্রাইল (আঃ)। তিনি অনেক উপরে উঠিয়া নিজের পাখাগুলি বিশেষতঃ সবুজ দুইটি পাখা মেলিয়া ধরেন। সাধারণত এই দুইটি পাখা রাত্রি ব্যতীত কখনও মেলেন না।

 

এই দুইটি ডানা মেলার কারণেই শবে কদরের ভোরে যখন সূর্যোদয় হয়, তখন উহার আলোক রশ্মি দেখা যায় না, বরং একটি চৌদ্দ তারিখের চন্দ্র বা স্বর্ণ থালার ন্যায় উহাকে দেখায়। অতঃপর একজন একজন করিয়া সকল ফেরেশতা উপরে উঠেন। ফেরেশতাদের নূর হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর নূরের সাথে একত্রিত হইয়া সূর্যের জ্যোতিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। ফেরেশতাকুলের নূরানী সমাবেশ দেখিয়া সূর্যও কিছুক্ষণের জন্য অভিভূত থাকে। এই অগণিত ফেরেশতা সেই দিন আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মোমেনের জন্য দু’আ এবং ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া সারা দিন অতিবাহিত করে। এই দু’আ তাহাদের জন্য যাহারা নিষ্ঠার সহিত সিয়াম পালন করিয়াছেন এবং আগামী বৎসর জীবিত থাকিলে রমযানের সিয়াম আরও উত্তমরূপে সম্পন্ন করিবেন বলিয়া নিয়ত করিয়াছেন। তাহারা সন্ধ্যা হইলে প্রথম আসমানে উঠেন এবং সেখানকার সমস্ত ফেরেশতা তাহাদের চতুর্পার্শ্বে ঘিরিয়া বসেন। দুনিয়াবাসী প্রত্যেক নারী-পুরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে থাকেন। জিব্রাইল (আঃ) এবং তাহার সহচরগণ এক একটি প্রশ্নের জওয়াব দান করেন। তাহারা এইরূপ প্রশ্নও করেন যে, এই বৎসর অমুক ব্যক্তিকে কেমন পাইয়াছেন? তখন তাহারা বলেন, গত বৎসর আমরা তাহাকে ইবাদতে রত অবস্থায় পাইয়াছিলাম, কিন্তু এই বৎসর আমরা তাহাকে পাপকার্যে লিপ্ত পাইয়াছি। অমুক ব্যক্তিকে আমরা গত বৎসর পাপে লিপ্ত পাইয়াছিলাম, কিন্তু এইবার আমরা তাহাকে ইবাদতে রত পাইয়াছি। তখন আসমানের ফেরেশতারা প্রথমোক্ত ব্যক্তির জন্য দু’আ বাদ দিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্য দু’আ আরম্ভ করিয়া দেন। ফেরেশতাগণ তাহাদের নিকট আরও বিস্তারিত বিবরণ দেন। অমুককে সালাতে পাইয়াছি, অমুককে কুরআন তেলাওয়াতে পাইয়াছি, অমুককে দরুদ পাঠাবস্থায় পাইয়াছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথম আসমানে একদিন একরাত কাটাইয়া তাহারা দ্বিতীয় আসমানে যান। সেখানেও প্রথম আসমানের ন্যায় প্রশ্ন করা হয় এবং মানুষের আমলের বিবরণ শুনানো হয়। এইভাবে তাঁহারা সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছান। তখন সিদরাতুল মুনতাহা ফেরেশতাগণকে বলেনঃ দেখ, তোমাদের উপর আমার হক আছে। যাহাকে আল্লাহ ভালবাসেন, আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। মানুষের অবস্থা আমার নিকটও একটু বর্ণনা করুন। হযরত কাব (রঃ) বলেন, তখন ফেরেশতাগণ প্রত্যেক মানুষের নাম তাহাদের পিতার নাম সহকারে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট এক এক করিয়া বর্ণনা করেন। অনন্তর জান্নাত উক্ত বৃক্ষের নিকট আরয করে যে, তোমার নিকট অবস্থানকারী ফেরেশতারা যাহা কিছু বলিয়াছেন, উহা আমার নিকট ব্যক্ত কর। সিদরাতুল মুনতাহা সমস্ত কিছু জান্নাতকে অবহিত করে। জান্নাত তখন বলে, অমুক পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক, অমুক নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। হে আল্লাহ! অতি সত্বর তাহাদিগকে আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিন।

অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) নিজের ঠিকানায় আগমন করিলে তাহার নিকট গায়েবী হুকুম প্রেরিত হয়। তিনি আল্লাহর নিকট বলেন, হে আল্লাহ! তোমার অমুক অমুক বান্দাকে সেজদারত পাইয়াছি। তুমি তাহাদিগকে ক্ষমা কর। আল্লাহ বলেন, আমি তাহাদিগকে ক্ষমা করিলাম। এই সংবাদ জিব্রাইল (আঃ) আরশের বাহক সকল ফেরেশতাকে শুনাইয়া দেন। তখন সকলেই বলিয়া উঠেন, অমুক অমুক বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া হইয়াছে। তাহাদিগকে ক্ষমা করা হইয়াছে। অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) আরয করেন, হে আল্লাহ! তোমার একজন বান্দাকে গত বছর সুন্নতের উপর পাইয়াছিলাম, কিন্তু এই বছর তাহাকে বিদ্‌ত্ততে লিপ্ত পাইলাম। মহান আল্লাহ তখন বলেন, হে জিব্রাইল! সে যদি মৃত্যুর তিন ঘন্টা পূর্বেও তওবা করে, তবে তাহাকে ক্ষমা করিব। জিব্রাইল (আঃ) বলিয়া উঠেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সকল প্রশংসার উপযুক্ত। এলাহী! তুমি সৃষ্টির উপর সবচেয়ে বেশী দয়ালু। বান্দার উপর তোমার দয়া তাহাদের আপন দয়া হইতেও অনেক বেশী। তখন আল্লাহর আরশ, আরশের পর্দা ও চতুর্দিকের সবকিছুই প্রকম্পিত করিয়া বলিয়া উঠে, আল হামদু লিল্লাহির রাহিম। আল হামদু লিল্লাহির রাহিম। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

উপরের আলোচনা থেকে কদর রাত্রির তাৎপর্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা জন্মে। এই লাইলাতুল কদরের রাত্রি জাগরণ ও ইবাদতে অনেক আবেদের দেল পরিচ্ছন্ন হয় এবং দেলে খোদার নূর চমকায়। সেই নূরে আবেদ আপন কালবের আয়নায় ঊর্ধ্ব জগতের দৃশ্যাবলী তথা বেহেশত, দোযখ, আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, আসমান, জমীন ইত্যাদি দেখিতে পায় যেমন টেলিভিশনের পর্দায় বিভিন্ন ছবি দেখা যায়। এই মহিমান্বিত রাত্রিতে ইবাদতকারীর গোনাহ খাতা ক্ষমা করিয়া দেওয়া হয়।

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

আপনার মন্তব্য

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আপনার ইমেইল এবং অন্যান্য তথ্য সংরক্ষন করুন

আপলোডকারীর তথ্য
ট্যাগস :

Discover more from Sufibad.Com - সূফীবাদ.কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

শাহসূফি খাজা ফরিদপুরী (কুঃ) ছাহেবের নসিহতের আলোকে

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

আপডেট সময় : ১১:২৩:৪০ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৪

লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্যঃ
লাইলাতুল কদরের গুরুত্ব ও তাৎপর্য সম্পর্কে ইমাম আবু মুহাম্মদ ইবনে আবু হাতিম (রঃ) হযরত কাব আহরার (রঃ) হইতে একটি বিস্ময়কর বর্ণনার উল্লেখ করিয়াছেন। তাহা হইলঃ
সপ্তম আকাশে জান্নাতের নিকটতম স্থানে সিদরাতুল মুনতাহা অবস্থিত। উক্ত গাছের প্রতিটি শাখা-প্রশাখায় অসংখ্য ফেরেশতা। এক চুল পরিমান খালিও নাই। ঐ গাছের মাঝামাঝি স্থানে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর আবাস। মোমেন বান্দাগণের প্রতি অতিশয় স্নেহশীল ও মমতার প্রতীক এই সব ফেরেশতাকে লইয়া শবে কদরে ভু-পৃষ্ঠে পদার্পণ করিবার জন্য মহান আল্লাহ হযরত জিব্রাইলকে (আঃ) নির্দেশ দেন। সব ফেরেশতা জিব্রাইল (আঃ) এর নেতৃত্বে পৃথিবীতে আগমন করেন এবং দুনিয়ার সর্বত্র ছড়াইয়া পড়েন। প্রত্যেক স্থানে সেজদা ও রুকু করেন। মোমেন নারী-পুরুষদের জন্য দু’আয় লিপ্ত হন। কিন্তু গির্যা, মন্দির, প্রতিমা ও অগ্নি পূজার স্থান, আবর্জনার স্তূপ, যে গৃহে নেশাখোর, বাদ্যযন্ত্র ও পুতুল প্রতিমা থাকে সেইসব জায়গা হইতে তাঁহারা দূরে সরিয়া থাকেন। এইভাবে সারা রাত্রি তাঁহারা পৃথিবীর আনাচে-কানাচে ঘুরিয়া বেড়ান এবং মোমেনদের জন্য মঙ্গল কামনা ও কল্যাণের জন্য দু’আ করিতে থাকেন। হযরত জিব্রাইল (আঃ) প্রত্যেক ঈমানদারের সহিত করমর্দন করেন। শরীর রোমাঞ্চিত হওয়া, হৃদয় বিগলিত হওয়া, চোখের পানি গড়াইয়া পড়া ইত্যাদি তাহার করমর্দনের আলামত।

এই অবস্থা অনুভূত হইলে বুঝিতে হইবে যে, এই মুহূর্তে আমার হাত জিব্রাইল (আঃ) এর হাতের ভিতর। হযরত কাব (রঃ) আরও বলিলেন, যে ব্যক্তি এই রাত্রিতে তিনবার ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ পড়িবে, প্রথম পাঠ করার বদৌলতে তাহাকে ক্ষমা করা হইবে, দ্বিতীয়বার পড়ার জন্যে সে দোযখ হইতে নিষ্কৃতি পাইবে, তৃতীয়বার উচ্চারণের ফলে সে জান্নাতে প্রবেশ করিবে। রাবী কর্তৃক তিনি জিজ্ঞাসিত হইলেন, হে আবু ইসহাক! যে ব্যক্তি এই কলেমাকে নিষ্ঠার সহিত বলিবে, কেবল তাহারই জন্য কি এই ফযিলত? তিনি বলিলেন, কেবল নিষ্ঠাবান সত্যবাদী ব্যক্তিই এই কলেমা পাঠ করিবে। আল্লাহর শপথ করিয়া বলিতেছি, পিঠে পাহাড় উঠাইয়া দিলে যেইরূপ ভারী মনে হয়, মুনাফেক ও কাফেরের পক্ষেও শবে কদর সেই রূপ ভারী মনে হইবে। ফজর পর্যন্ত ফেরেশতারা এই রূপে অবস্থান করেন। অতঃপর আসমানে প্রথম আরোহণ করেন হযরত জিব্রাইল (আঃ)। তিনি অনেক উপরে উঠিয়া নিজের পাখাগুলি বিশেষতঃ সবুজ দুইটি পাখা মেলিয়া ধরেন। সাধারণত এই দুইটি পাখা রাত্রি ব্যতীত কখনও মেলেন না।

 

এই দুইটি ডানা মেলার কারণেই শবে কদরের ভোরে যখন সূর্যোদয় হয়, তখন উহার আলোক রশ্মি দেখা যায় না, বরং একটি চৌদ্দ তারিখের চন্দ্র বা স্বর্ণ থালার ন্যায় উহাকে দেখায়। অতঃপর একজন একজন করিয়া সকল ফেরেশতা উপরে উঠেন। ফেরেশতাদের নূর হযরত জিব্রাইল (আঃ) এর নূরের সাথে একত্রিত হইয়া সূর্যের জ্যোতিকে আচ্ছন্ন করিয়া ফেলে। ফেরেশতাকুলের নূরানী সমাবেশ দেখিয়া সূর্যও কিছুক্ষণের জন্য অভিভূত থাকে। এই অগণিত ফেরেশতা সেই দিন আসমান ও জমিনের মধ্যবর্তী স্থানে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল মোমেনের জন্য দু’আ এবং ক্ষমা ভিক্ষা করিয়া সারা দিন অতিবাহিত করে। এই দু’আ তাহাদের জন্য যাহারা নিষ্ঠার সহিত সিয়াম পালন করিয়াছেন এবং আগামী বৎসর জীবিত থাকিলে রমযানের সিয়াম আরও উত্তমরূপে সম্পন্ন করিবেন বলিয়া নিয়ত করিয়াছেন। তাহারা সন্ধ্যা হইলে প্রথম আসমানে উঠেন এবং সেখানকার সমস্ত ফেরেশতা তাহাদের চতুর্পার্শ্বে ঘিরিয়া বসেন। দুনিয়াবাসী প্রত্যেক নারী-পুরুষ সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করিতে থাকেন। জিব্রাইল (আঃ) এবং তাহার সহচরগণ এক একটি প্রশ্নের জওয়াব দান করেন। তাহারা এইরূপ প্রশ্নও করেন যে, এই বৎসর অমুক ব্যক্তিকে কেমন পাইয়াছেন? তখন তাহারা বলেন, গত বৎসর আমরা তাহাকে ইবাদতে রত অবস্থায় পাইয়াছিলাম, কিন্তু এই বৎসর আমরা তাহাকে পাপকার্যে লিপ্ত পাইয়াছি। অমুক ব্যক্তিকে আমরা গত বৎসর পাপে লিপ্ত পাইয়াছিলাম, কিন্তু এইবার আমরা তাহাকে ইবাদতে রত পাইয়াছি। তখন আসমানের ফেরেশতারা প্রথমোক্ত ব্যক্তির জন্য দু’আ বাদ দিয়া দ্বিতীয় ব্যক্তির জন্য দু’আ আরম্ভ করিয়া দেন। ফেরেশতাগণ তাহাদের নিকট আরও বিস্তারিত বিবরণ দেন। অমুককে সালাতে পাইয়াছি, অমুককে কুরআন তেলাওয়াতে পাইয়াছি, অমুককে দরুদ পাঠাবস্থায় পাইয়াছি ইত্যাদি ইত্যাদি।

প্রথম আসমানে একদিন একরাত কাটাইয়া তাহারা দ্বিতীয় আসমানে যান। সেখানেও প্রথম আসমানের ন্যায় প্রশ্ন করা হয় এবং মানুষের আমলের বিবরণ শুনানো হয়। এইভাবে তাঁহারা সিদরাতুল মুনতাহা পর্যন্ত পৌঁছান। তখন সিদরাতুল মুনতাহা ফেরেশতাগণকে বলেনঃ দেখ, তোমাদের উপর আমার হক আছে। যাহাকে আল্লাহ ভালবাসেন, আমি তাহাদিগকে ভালবাসি। মানুষের অবস্থা আমার নিকটও একটু বর্ণনা করুন। হযরত কাব (রঃ) বলেন, তখন ফেরেশতাগণ প্রত্যেক মানুষের নাম তাহাদের পিতার নাম সহকারে সিদরাতুল মুনতাহার নিকট এক এক করিয়া বর্ণনা করেন। অনন্তর জান্নাত উক্ত বৃক্ষের নিকট আরয করে যে, তোমার নিকট অবস্থানকারী ফেরেশতারা যাহা কিছু বলিয়াছেন, উহা আমার নিকট ব্যক্ত কর। সিদরাতুল মুনতাহা সমস্ত কিছু জান্নাতকে অবহিত করে। জান্নাত তখন বলে, অমুক পুরুষের উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক, অমুক নারীর উপর আল্লাহর রহমত বর্ষিত হউক। হে আল্লাহ! অতি সত্বর তাহাদিগকে আমার নিকট পৌঁছাইয়া দিন।

অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) নিজের ঠিকানায় আগমন করিলে তাহার নিকট গায়েবী হুকুম প্রেরিত হয়। তিনি আল্লাহর নিকট বলেন, হে আল্লাহ! তোমার অমুক অমুক বান্দাকে সেজদারত পাইয়াছি। তুমি তাহাদিগকে ক্ষমা কর। আল্লাহ বলেন, আমি তাহাদিগকে ক্ষমা করিলাম। এই সংবাদ জিব্রাইল (আঃ) আরশের বাহক সকল ফেরেশতাকে শুনাইয়া দেন। তখন সকলেই বলিয়া উঠেন, অমুক অমুক বান্দার ওপর আল্লাহর দয়া হইয়াছে। তাহাদিগকে ক্ষমা করা হইয়াছে। অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) আরয করেন, হে আল্লাহ! তোমার একজন বান্দাকে গত বছর সুন্নতের উপর পাইয়াছিলাম, কিন্তু এই বছর তাহাকে বিদ্‌ত্ততে লিপ্ত পাইলাম। মহান আল্লাহ তখন বলেন, হে জিব্রাইল! সে যদি মৃত্যুর তিন ঘন্টা পূর্বেও তওবা করে, তবে তাহাকে ক্ষমা করিব। জিব্রাইল (আঃ) বলিয়া উঠেনঃ হে আল্লাহ! তুমি সকল প্রশংসার উপযুক্ত। এলাহী! তুমি সৃষ্টির উপর সবচেয়ে বেশী দয়ালু। বান্দার উপর তোমার দয়া তাহাদের আপন দয়া হইতেও অনেক বেশী। তখন আল্লাহর আরশ, আরশের পর্দা ও চতুর্দিকের সবকিছুই প্রকম্পিত করিয়া বলিয়া উঠে, আল হামদু লিল্লাহির রাহিম। আল হামদু লিল্লাহির রাহিম। (তাফসীরে ইবনে কাসীর)

উপরের আলোচনা থেকে কদর রাত্রির তাৎপর্য সম্পর্কে সহজেই ধারণা জন্মে। এই লাইলাতুল কদরের রাত্রি জাগরণ ও ইবাদতে অনেক আবেদের দেল পরিচ্ছন্ন হয় এবং দেলে খোদার নূর চমকায়। সেই নূরে আবেদ আপন কালবের আয়নায় ঊর্ধ্ব জগতের দৃশ্যাবলী তথা বেহেশত, দোযখ, আরশ, কুরছি, লওহ, কলম, আসমান, জমীন ইত্যাদি দেখিতে পায় যেমন টেলিভিশনের পর্দায় বিভিন্ন ছবি দেখা যায়। এই মহিমান্বিত রাত্রিতে ইবাদতকারীর গোনাহ খাতা ক্ষমা করিয়া দেওয়া হয়।