শের, খফি ও আখফা: আত্মিক অবস্থার তিন স্তর

- আপডেট সময় : ১১:১৪:৫১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ১৮ মার্চ ২০২৫
- / ২৪০৬ বার পড়া হয়েছে
শের, খফি ও আখফা: আত্মিক অবস্থার তিন স্তর
সুফিবাদের মধ্যে আত্মিক উন্নতি ও আত্মার পরিচ্ছন্নতার বিভিন্ন স্তর রয়েছে। এসব স্তরের মাধ্যমে একজন সালিক (আধ্যাত্মিক পথিক) ধীরে ধীরে আল্লাহর নৈকট্য লাভ করেন। তাসাউফে ধ্যান, জিকির ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে এ স্তরগুলো অর্জিত হয়। এর মধ্যে তিনটি গুরুত্বপূর্ণ স্তর হলো শের, খফি ও আখফা।
১. শের (জাহেরি জিকির বা প্রকাশ্য জিকির)
শের শব্দের অর্থ প্রকাশ্য বা দৃশ্যমান। এটি এমন জিকির যা মুখে উচ্চারণ করে বা স্বরযুক্তভাবে করা হয়। এ ধরনের জিকির সাধারণত একজন সালিককে প্রথমে দেওয়া হয়, যাতে তার মন আল্লাহর স্মরণে অভ্যস্ত হয় এবং আলস্য দূর হয়।
শের জিকিরের বৈশিষ্ট্য:
সাধারণত উচ্চ কণ্ঠে করা হয়।
শব্দযুক্ত হওয়ায় এটি শরীর ও মস্তিষ্ককে সক্রিয় করে।
নবী করিম (সা.) এবং সাহাবিগণ যুদ্ধের সময়, আজান, তাকবির, দোয়া ইত্যাদিতে উচ্চ কণ্ঠে জিকির করতেন।
এটি অন্তরের কঠিনতা দূর করে এবং আত্মাকে আল্লাহর ধ্যানে অভ্যস্ত করে।
আরো পড়ুন:রাবেতা: সুফিবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ সাধনা
উদাহরণ:
“লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” জোরে বলা।
দস্তরখানায় বা মজলিসে সমবেতভাবে আল্লাহর নাম ধ্বনিত করা।
আজান, তাকবির ইত্যাদি প্রকাশ্যভাবে পাঠ করা।
২. খফি (গোপন জিকির বা নীরব জিকির)
খফি শব্দের অর্থ লুকায়িত বা গোপন। এটি এমন জিকির যা চুপচাপ, মৃদু স্বরে বা কেবল অন্তরে করা হয়। সালিক যখন জাহেরি জিকিরের অভ্যাসে অভ্যস্ত হয়ে যান, তখন তাকে খফি জিকিরের দীক্ষা দেওয়া হয়।
খফি জিকিরের বৈশিষ্ট্য:
কণ্ঠনালির স্পন্দন হয়, তবে স্বর শোনা যায় না।
এটি অন্তরের সঙ্গে গভীর সংযোগ স্থাপন করে।
দুনিয়ার চিন্তা কমিয়ে মনকে একাগ্র করে।
কোরআনুল কারিমে খফি জিকিরের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে:
“তোমরা তোমাদের রবকে মনে মনে বিনীতভাবে ও ভয়ভীতির সঙ্গে জিকির করো, অনুচ্চ স্বরে সকালে ও সন্ধ্যায়, এবং গাফিলদের অন্তর্ভুক্ত হয়ো না।”
(সূরা আল-আ‘রাফ: ২০৫)
উদাহরণ:
মনে মনে “লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ” পাঠ করা।
অন্তরে আল্লাহর নাম ধ্যান করা।
নীরবে আল্লাহর প্রশংসা করা।
৩. আখফা (গুপ্ততম জিকির বা হৃদয়ের জিকির)
আখফা শব্দের অর্থ সবচেয়ে গোপন বা অন্তরের গভীরতম স্তর। এটি এমন জিকির যা মনের চেয়েও গভীরে আত্মায় অনুভূত হয়। এই স্তর একজন সালিক দীর্ঘ সাধনা ও আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে অর্জন করেন।
আখফা জিকিরের বৈশিষ্ট্য:
এটি সম্পূর্ণ নীরব, এমনকি অন্তরের আওয়াজও থাকে না।
আল্লাহর স্মরণ অন্তরের গভীরে চলে যায়, কোনো শব্দ বা চিন্তা ছাড়াই।
এটি সালিককে আল্লাহর সঙ্গে গভীর সম্পর্ক স্থাপনে সাহায্য করে।
এটি হাকিকত ও মারিফাতের উচ্চস্তরে পৌঁছানোর মাধ্যম।
উদাহরণ:
হৃদয়ের গভীরে আল্লাহর উপস্থিতি অনুভব করা।
চিন্তা ছাড়াই আত্মার মধ্যে আল্লাহর ভালোবাসা ও স্মৃতি ধরে রাখা।
গভীর ধ্যানের মাধ্যমে আত্মার সাথে আল্লাহর সংযোগ অনুভব করা।
আরো পড়ুন:রতী সাধন: আধ্যাত্মিক ও জাগতিক দৃষ্টিভঙ্গি
শের, খফি ও আখফা—এই তিনটি স্তর একজন সালিকের আত্মশুদ্ধির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাওয়ার মাধ্যম। প্রথমে প্রকাশ্য জিকির (শের) দিয়ে শুরু হয়, তারপর অভ্যন্তরীণ স্তরে (খফি) চলে যায় এবং শেষে আত্মার গভীরতম স্তরে (আখফা) পৌঁছে যায়। এসব স্তর পার হয়ে গেলে একজন সালিক আল্লাহর সঙ্গে প্রকৃত সংযোগ স্থাপন করতে পারেন এবং সত্যিকারের আত্মিক প্রশান্তি অর্জন করতে সক্ষম হন।
আল্লাহ আমাদের সবাইকে এই পবিত্র পথের অনুসারী হওয়ার তাওফিক দান করুন। আমিন।