মিডিয়ার উপর খাজাবাবা ফরিদপুরীর (কুঃছেঃআঃ) আধ্যাত্মিক প্রভাব
- আপডেট সময় : ১২:০৪:৪৮ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৪
- / ২৩৯৬ বার পড়া হয়েছে
আশির দশকের মাঝামাঝি সময়ে হযরত পীর কেবলাজান হুজুর খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবের সম্মতিক্রমে পবিত্র শবে কদর উপলক্ষে তরিকাপন্থী আলেম-ওলামা বিশেষ করে জাকেরানদের নিয়ে বাংলাদেশ বেতারের ঢাকা কেন্দ্র হতে ১ ঘন্টা সময়সীমার মধ্যে একটি বিশেষ মিলাদ মাহফিল প্রচারের ব্যবস্থা নেয়া হয়। যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে বিপুল সংখ্যক আলেম- ওলামা সমন্বয়ে শেরেবাংলা নগরস্থ জাতীয় বেতার ভবন মিলনায়তনে মিলাদ মাহফিল রেকর্ডিং এর সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়। উলেখ্য, বিগত বছরগুলোতে একই উপলক্ষে যে সকল মিলাদ মাহফিল প্রচার করা হয় সেগুলো ছিল একেবারেই নিষ্প্রাণ, গতানুগতিক এবং সর্বোচ্চ ৩০ থেকে ৪৫ মিনিট সময়সীমার। এবারই প্রথম রেডিওর মিলাদ মাহফিলে পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত এবং হামদ-নাত ছাড়াও সংশ্লিষ্ট বিষয়ভিত্তিক আলোচনা, গজল, বাংলা-আরবী-উর্দু ক্বাসিদা আর আল্লাহ-রাসুলের মহব্বত সৃষ্টিকারী সুমধুর ছামা সহকারে ইসমে জাতের জলি জিকির সংযোজন করা হয়। ফলে মিলাদ মাহফিল রেকর্ডিং এর সময় উপস্থিত আলেম-ওলামা ও অন্যান্য অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে অভূতপূর্ব ফায়েজ ওয়ারেদ হয়। বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের পেশ ইমাম, সুকন্ঠের অধিকারী মাওলানা সাদেকুর রহমানের পরিচালনায় উক্ত মিলাদ মাহফিলে আলোচনায় অংশ নেন ঢাকা আলীয়া মাদ্রাসার প্রখ্যাত শিক্ষাবিদ আলহাজ্ব মাওলানা সালাহউদ্দিন ও বিশিষ্ট বেতার ব্যক্তিত্ব আলহাজ্ব মাওলানা আবু ল্লাইস আনসারী। উন্নত পরিকল্পনা ও নতুন আঙ্গিকে গ্রন্থিত ফায়েজপূর্ণ এ মিলাদ মাহফিল রেকর্ডিং এর সময় উপস্থিত এক শ্রেণীর ঈর্ষাকাতর আলেম-ওলামা পরস্পরের মধ্যে নানা ধরণের কানাঘুষা শুরু করেন। কিন্তু আমি ওসবের পাত্তা না দিয়ে রেকর্ডকৃত মিলাদ মাহফিল প্রচারের জন্য সংশিষ্ট বিভাগে জমা দিয়ে দু’দিনের ছুটি নিলাম। উদ্দেশ্য, পরের দিন আটরশি গিয়ে রাত ১০টায় পীর কেবলাজানের সান্নিধ্যে বসে পবিত্র শবে কদর উপলক্ষে প্রচারিতব্য উপরোক্ত মিলাদ মাহফিল শুনব।
কিন্তু পরের দিন সূর্যোদয়ের পূর্বে প্রত্যুষে এক স্বপ্নে দেখলাম, হযরত কেবলাজান হুজুর গেঞ্জী-লুঙ্গি পরিহিত যুদ্ধক্লান্ত, যেন এইমাত্র রণাঙ্গন থেকে এলেন। হযরত কেবলাজান হুজুরকে চিনতে পেরে যেইমাত্র কদমবুচি করলাম, তখনই তিনি আমার মাথায় হাত রেখে অত্যন্ত স্নেহমাখা কোমল কন্ঠে বললেন, “বাবা, আমি দোয়া করি। আপনার দরবারে আসার দরকার নেই।” পীর কেবলাজান আমাকে দরবারে যেতে নিষেধ করলেন বলে আমার কোন ভুল বেয়াদবি হয়েছে মনে করে খুবই চিন্তিত হয়ে পড়লাম এবং সকাল পর্যন্ত কেঁদে কেঁদে বুক ভাসালাম। একটু বেলা বাড়তেই স্বপ্নের কথা মনে করে একটা নতুন চিন্তা মাথায় এলো। রেকর্ডকৃত মিলাদ মাহফিল প্রচারে কোন বিঘ্ন বা ঝামেলা হলো কিনা একথা ভেবে তরিৎ গতিতে অফিসে গিয়ে পৌছতেই পিয়ন জানালো যে, আর.ডি. সাহেব (কেন্দ্র পরিচালক) কয়েকবার আমার খোঁজ করেছেন। আমি সাথে সাথেই পরিচালকের কক্ষে গিয়ে যে দৃশ্য দেখলাম তাতে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলাম। পরিচালকসহ ১০/১২ জন সিনিয়র অফিসার রুদ্ধদ্বার কক্ষে বসে পবিত্র শবে কদর উপলক্ষে রেকর্ডকৃত সেই মিলাদ মাহফিল শুনছেন। কিছু একটা ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে অজানা আশংকায় আমার গা কাঁটা দিয়ে উঠল। তাহলে কি মিলাদ মাহফিল প্রচার বন্ধ রাখার জন্য কোন গোপন ষড়যন্ত্র! এদিকে আমি গতকালই রেকর্ডিং এর পর টেলিফোনে মিলাদ মাহফিল প্রচারের দিনক্ষণ ও সময় হযরত কেবলাজান হুজুরকে জানিয়ে দিয়েছিলাম। কাজেই এখন সেই মিলাদ মাহফিল প্রচার না হলে আমি একজন মিথ্যেবাদী প্রতারক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে যেতে পারি, সেই ভয়ে ক্ষণিকের জন্য মুষড়ে পড়লাম। কিন্তু পরক্ষণেই সম্বিৎ ফিরে পেলাম। হযরত কেবলাজান হুজুরের তরফ থেকে এক ধরণের শক্তি ও সাহস পেয়ে আমার স্বভাবজাত মেজাজ ও ব্যক্তিত্ব নিয়ে পরিচালক সাহেবকে জিজ্ঞেস করলাম, “কি ব্যাপার! সবাই মিলে দরজা বন্ধ করে মিলাদ মাহফিল শুনছেন কেন? আমার সেকশন, আমার অনুষ্ঠান অথচ আমাকে না জানিয়ে এ ধরণের গোপন তৎপরতা আপত্তিকর।” আমার মনের অবস্থা টের পেয়ে স্বয়ং পরিচালক সাহেবই জানালেন যে, আমাদেরই কোন এক সহকর্মী এটাকে আটরশির মিলাদ মাহফিল বলে অভিযোগ তুলেছেন। কারণ এতে কিছু নতুন বিষয় ছাড়াও ছামাসহ জিকির সংযোজন করা হয়েছে যা কিনা জাকেরদের জলছা মাহফিলে শুনতে পাওয়া যায়। মিলাদ মাহফিলে গজল ও আল্লাহর নামের জিকির হারাম কিনা আমি এ প্রশ্ন করতেই সবাই নিরুত্তর হয়ে গেলো। আলোচ্য মিলাদ মাহফিলে আর কোন আপত্তি আছে কিনা পরিচালক সাহেব একথা জিজ্ঞেস করতেই সবাই “না” সূচক জবাব দিলেন। এদিকে পরিচালক সাহেব আমাকে অনুরোধের সুরে বললেন যেন জিকিরের কিছু অংশ বাদ দিয়ে একটু সংক্ষিপ্ত করে দেই। অনুষ্ঠান প্রচারের স্বার্থে আমি রাজী হয়ে তৎকালীন প্রযোজনা সহকারী রইছউদ্দিনকে সাথে নিয়ে এডিটিং রুমে গেলাম। কিন্তু রইছউদ্দিন আমাকে অবাক করে দিয়ে অত্যন্ত দৃঢ় কন্ঠে বলে উঠল, “স্যার, আল্লাহর নামের জিকির আমি একচুল পরিমাণও কাটতে পারবোনা। আপনি নিশ্চিন্তে দরবার শরীফে (আটরশি) চলে যান। মিলাদ মাহফিল এডিটিং এর দায়দায়িত্ব আমি নিলাম।”
আমি তৎক্ষণাৎ বাসায় ফিরে কাপড়ের ব্যাগটি হাতে নিয়েই দরবার শরীফের উদ্দেশ্যে দ্রুত রওয়ানা হয়ে গেলাম। সারাপথে শুধু একটাই চিন্তা, হুজুর কেবলাজানের কদম মুবারকে গিয়ে পবিত্র শবে ক্বদরের ইফতার করব, আর রাত ১০টায় সেই ঐতিহাসিক মিলাদ মাহফিল শুনব। কিন্তু সারাপথে নানা যানবাহনে চড়ে আমি যখন পুকুরিয়া পৌছলাম তখন ইফতারের বাকী আর মাত্র ২০ মিনিট সময়। সেসময় পুকুরিয়া থেকে দরবার শরীফ পর্যন্ত প্রায় আট মাইল পথ পাড়ি দিতে একমাত্র বাহন নড়বড়ে রিকসাভ্যান ছাড়া আর কোন উন্নত যানবাহনের ব্যবস্থা ছিলনা। কাজেই ২০ মিনিট সময়ের মধ্যে দরবার শরীফে পৌছানো কোনমতেই সম্ভব নয় এ কথা ভেবে মনটা খুবই বিষন্ন হয়ে গেলো। এত কষ্ট করে, এত বাধা-বিপত্তি ও চড়াই-উৎরাই পার হয়ে শেষ পর্যন্ত এত কাছে এসে আটকে গেলাম। যখন অনুতাপ-অনুশোচনায় এসব কথা ভাবছিলাম ঠিক তখনই ঢাকার দিক থেকে আসা একটি মাইক্রোবাস আমার পাশ কেটে অল্প কিছুদুর সামনে গিয়েই হার্ড ব্রেক কষে থেমে গেল। ভেতর থেকে অপরিচিত একজন আমার দিকে হাত নেড়ে ডেকে বললেন, “ভাইজান, দাঁড়িয়ে আছেন কেন, দরবারে গিয়ে ইফতার করবেননা? জলদি আসেন।” আমি ছুটে গিয়ে মাইক্রোবাসে উঠলাম। কিন্তু আমার মনের অবস্থা তখন এমন যে, কার গাড়ীতে গেলাম, গাড়ীতে কে কে ছিলেন, ক’জন ছিলেন এসবের কোন খবরই ছিলনা। যাহোক ইফতারের দু’তিন মিনিট আগেই দরবার শরীফে গিয়ে পৌছে গেলাম। হযরত কেবলাজান হুজুর প্রতিদিনের মতো সেদিনও দক্ষিণ হুজরা শরীফের বারান্দায় পশ্চিম দিকে বসে জাকেরানদের সাথে শেষ মুহুর্তের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন, সবাইকে ইফতারীর প্লেট নিয়ে বসতে বলছেন। এমনি সময়ে আমি গিয়ে হাজির। একটু দুরে থাকতেই আমাকে দেখে পীর কেবলাজান হুজুর সেই সুস্নিগ্ধ বেহেশতী হাসি হেসে ইফতার হাতে নেয়ার নির্দেশ দিলেন। আমি কদমবুচি করে মিলাদ মাহফিলের সুসংবাদ দিতেই হযরত কেবলাজান হুজুরের চেহারা মুবারকে আরেক ঝলক নূরান্বিত হাসি ও সন্তোষের আভা ফুটে উঠল।
দরবার শরীফে সেই দিন এক ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটল। এশা ও তারাবী নামাজের পর মসজিদে বসে পীর কেবলাজান নিজেই পাক জবানে ইমাম সাহেবকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “মাওলানা সাব, এখন রেডিওতে মিলাদ মাহফিল প্রচার হবে। সবাই মিলাদ মাহফিল শুনবেন। কাজেই এখন দরুদ শরীফ পড়াবেননা। মিলাদ মাহফিলের পর দরুদ শরীফ পড়াইয়া দিবেন।” পীর কেবলাজানের নির্দেশে দরবার শরীফের সব মাইকে রেডিওর মিলাদ মাহফিল প্রচার করা হলো। এদিকে রাজধানীতে বাড্ডার মহিউদ্দিন মোল্লা ভাইসহ কোন কোন মহল্লার নেতৃত্বস্থানীয় জাকের ভাইরা পূর্বাহ্নে জানতে পেরে বিভিন্ন স্থানে মাইক লাগিয়ে একই মিলাদ মাহফিল রেডিও থেকে প্রচার করে মহল্লাবাসীকে শোনানোর ব্যবস্থা করেন। মোটকথায় দরবার শরীফসহ দেশের সর্বত্রই সেই মিলাদ মাহফিলের ফায়েজ ও তাছিরে তুমুল সাড়া পড়ে গেল।
হযরত কেবলাজান হুজুর ৩নং হুজরা শরীফে বসে মনোযোগ ও আগ্রহের সাথে পুরো এক ঘন্টার মিলাদ মাহফিল শুনলেন। পরে অপেক্ষমান দরবারের আলেম- ওলামা ও খাদেমগণের সাথে কথা বলার সময় মিলাদ মাহফিলের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করলেন, অচিরেই ইসলামের বিজয় সংকেত দিয়ে নানা মন্তব্য করলেন। পরের দিন বিদায়ের সময় পীর কেবলাজান মধুর কন্ঠে কাছে ডেকে আমাকে বললেন, “বাবা, ইসলামের পথে এটা একটা জেহাদ। এটা আপনার একক জেহাদ। ইসলামের পথে এটা প্রথম বিজয়। আমি দোয়া করি, আল্লাহ যেন আপনাকে আরো তৌফিক দেন।” সেই যে আশেকে রাসুলগণের মাধ্যমে প্রতিবছর রেডিও থেকে এক ঘন্টা সময়সীমার দুটি বিশেষ মিলাদ মাহফিল (পবিত্র শবে কদর ও ঈদে মিলাদুন্নবী) প্রচার শুরু হলো, তা প্রায় একটানা দশ বছর ধরে আমার অবসর গ্রহণের পূর্ব পর্যন্ত অব্যাহত ছিল।