পদ্মার স্রোতে হারিয়ে যাওয়া তরুণের জীবন লাভ
- আপডেট সময় : ১১:৫২:৩১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ২৩ অগাস্ট ২০২৪
- / ২৩৯৮ বার পড়া হয়েছে
১৯৮১-৮২ইং সনের কোন এক ভরা বর্ষায় বৃহত্তর বরিশালের ৬ জেলার ৪২টি খানা থেকে ৩৭ লঞ্চের এক বিশাল কাফেলা নিয়ে হাফেজ আব্দুল গণির নেতৃত্বে হাজার হাজার জাকেরান আশেকান হযরত শাহসুফী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) কেবলাজান ছাহেবকে একনজর দেখা এবং তদীয় পবিত্র হস্ত মুবারকে বায়াত গ্রহণ তথা মুরীদ হওয়ার জন্য বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। এই বিশাল ইসলামী কাফেলা পদ্মার উত্তাল তরঙ্গ ভেঙ্গে দ্রুতবেগে এগিয়ে চলছে সামনের দিকে। হাফেজ গণি সর্বশেষ পেছনের লঞ্চটিতে সাদা পতাকা লাগিয়ে বসে আছেন কোন লঞ্চ বিকল হলো কিনা তা পর্যবেক্ষণের জন্য। এটা কাফেলার নেতা বা টীম লিডারেরই দায়িত্ব। “আল্লাহু আকবার” ও “কালেমা তাইয়্যেবা” লেখা ব্যানার ও নানা রঙের ফেস্টুনে সাজানো ৩৭টি লঞ্চের এ মনোমুগ্ধকর দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছিল দিন্দ্বীজয়ী ইসলামী সৈনিকদের বিজয় উল্লাসে উদ্বেলিত এ যেন এক আনন্দ মিছিল বা দিগন্ত প্রসারী নতুন কোন এক অভিযাত্রা।
সহযাত্রী আল্লাহ প্রেমিকদের জিকির ও জজবার আবেগ যখন নদী তরঙ্গে আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে পড়ছিল ঠিক তখনই একজন সহযাত্রী জাকের ভাই হাফেজ গণিকে জানালেন যে, সেই লঞ্চেরই একজন যাত্রী ছাদের উপর থেকে পা ফসকে পড়ে গিয়ে পদ্মার গভীর পানিতে তলিয়ে গেছে। এর অনেক আগেই নদীবক্ষে অন্ধকার রাত নেমে এসেছে। শুধু তাই নয়, পদ্মার বুকে তখন বয়ে চলছিল প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি। কাজেই এ অপ্রত্যাশিত আকস্মিক দুর্ঘটনার সংবাদ শোনামাত্রই মুহুর্তকাল বিলম্ব না করে হাফেজ আব্দুল গণি লঞ্চের চালককে বলে দীর্ঘ সময় ধরে প্রচন্ড ঢেউ ও বাতাসের সাথে যুদ্ধ করে সম্ভাব্য সব এলাকায় সার্চলাইটের আলো ফেলে তন্নতন্ন করে খুঁজেও লোকটির কোন সন্ধান পেলেননা। গণি ভাই ভাবলেন ঝড়বৃষ্টির শব্দে অন্ধকারে বিভ্রান্ত হয়ে হয়তোবা কেউ ভুল খবর দিয়ে থাকবে। তবুও অনেক দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ ও আশংকার বোঝা নিয়ে অবশেষে সন্ধান প্রয়াশ বাতিল করে তারা পুনরায় দরবার শরীফের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। খুব দ্রুত লঞ্চ চালিয়ে আগে চলে যাওয়া মুল কাফেলার সাথে আবার সম্মিলিত হয়ে পিয়াজখালি ঘাটে গিয়ে অন্যান্য লঞ্চের পাশেই হাফেজ গণির লঞ্চটিও নোঙ্গর করল। পুরো কাফেলার লোকজন এক সময় দরবার শরীফে পৌঁছে হুজুর পাকের সাথে দেখা করতে শুরু করলেন।
এদিকে হাফেজ গণি দরবারে পৌছামাত্র উপস্থিত কয়েকজন এসে তাকে বললেন, “ভাইজান, আপনাদের কাফেলার যে লোকটি লঞ্চ থেকে নদীতে পড়ে গিয়েছিল সে বেঁচে আছে এবং কাফেলার আগেই দরবারে এসে পৌছে গেছে।” হাফেজ আব্দুল গণি এ কথা শুনে বিস্ময়ে হতবাক ও স্তম্ভিত হয়ে গেলেন। ঝড়-বৃষ্টি ও অন্ধকার রাতে দীর্ঘ সময় লঞ্চ দিয়ে খুঁজেও যাকে পাওয়া গেলনা তিনি কি করে বেঁচে আছেন এবং সবার আগে দরবারে এলেন এ ঘটনা জানার জন্য হাফেজ গণি তাকে তৎক্ষণাৎ খুঁজে বের করে আনলেন এবং আদ্যোপান্ত শুনে অবাক হলেন। নিখোঁজ যাত্রীটি ছিল ভোলা জেলার আঙ্গুরহাট এলাকার এক তরুণ।
জীবনে এই প্রথমবার দরবার শরীফে আসা। লঞ্চ কাফেলার হাজার হাজার লোকের সাথে কৌতুহলবশতঃ তিনিও লঞ্চে উঠে পড়েন। মনে মনে খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবকে এক নজর দেখারও তীব্র বাসনা ও আকাঙ্খা তার ছিল। হাফেজ গণির প্রশ্নের উত্তরে তিনি একে একে বলে চললেন তাঁর রোমাঞ্চকর বেঁচে থাকার কাহিনীঃ
“নদীতে পড়ে গিয়ে যখন তরুণটি প্রচন্ড স্রোত ও ঢেউয়ের মধ্যে সাঁতার কেটে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন, তখন হঠাৎ তার মনে হলো কে যেন তার পিঠের নিচে কোন কিছুর সাহায্যে ঠেস দিয়ে তাকে উত্তাল তরঙ্গমালার উপর ভাসিয়ে রেখেছেন। এমনকি হাফেজ গণি যে লঞ্চ নিয়ে তাকে খুঁজছিলেন সে দৃশ্যও তিনি দীর্ঘ সময় ধরে দেখেছেন, কিন্তু অন্য কেউ তাকে দেখেননি এটা একটা আশ্চর্যের ব্যাপার। তরুণটি আরও জানালেন যে, তিনি কাউকে ডাকতেও পারছিলেননা কারণ তার মুখ দিয়ে কোন শব্দ বের হচ্ছিলনা। এমতাবস্থায় মৃত্যু অনিবার্য বুঝতে পেরে তরুণটি হযরত শাহসূফী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবকে উদ্দেশ্যে করে মনে মনে বললেন, “হুজুর, আমি আপনাকে দেখার জন্য বাবা মাকে না বলে চলে এসেছি। এখন যদি পানিতে ডুবে আমার মৃত্যু হয়, তাহলে আমার বাবা-মা জীবনেও আমাকে দেখতে পাবেননা। সেই শোকে হয় তারা পাগল হবে নয়তো মারা যাবেন।” তরুণটি পরম করুণাময় আলাহ পাকের দরবারে এই বলে ফরিয়াদ জানালেন, “হে আল্লাহ, কামেল পীরের ওসিলায় আমাকে সাহায্য করেন, আমাকে বাঁচান।” ঠিক সেই মুহুর্তে হঠাৎ একজন বৃদ্ধ মাঝি ছোট্ট একটি ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে এসে তরুণটিকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে গেলেন এবং সেখানকার লোকজনকে বলে দিলেন যেন তারা অসহায় ছেলেটিকে লাইনের লঞ্চে তুলে দেন।”
হাফেজ গণির আর বুঝতে বাকি রইলোনা যে, এ মাঝি আর কেউ নয়, স্বয়ং কেবলাজান হুজুর খাজাবাবা ফরিদপুরী (কুঃছেঃআঃ) ছাহেবই মাঝির বেশে কাফেলায় আসা বিপন্ন তরুণটিকে উদ্ধার করে নিয়ে এসেছেন। কারণ, যেখানে এমন অন্ধকার দুর্যোগপূর্ণ রাতে লঞ্চের সাহায্যে সার্চলাইট দিয়েও তরুণটিকে খুঁজে পাওয়া গেলনা, সেখানে একাকী একজন বৃদ্ধ মাঝি একটি ছোট্ট ডিঙ্গি নৌকার সাহায্যে তাকে উদ্ধার করে শুধু প্রাণেই বাঁচিয়ে দিলেননা, কাফেলার আগে তার কাঙ্খিত গন্তব্য বিশ্বওলীর দরবারে বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে পৌছে দেয়ারও যথাযথ ব্যবস্থা করে দিলেন। এটা কি সাধারণ কোন ঘটনা? হাফেজ গণি এবার তরুণটিকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি সেই মাঝিটিকে দেখলে চিনতে পারবে?”
তরুণটি বললো, “হ্যাঁ, পারবো। যে মাঝি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছেন তাকে দেখলেই চিনতে পারবো।” হযরত কেবলাজান হুজুর তখন লোকজনের সাথে সাক্ষাত দিচ্ছিলেন। হাফেজ গণি তরুণটিকে সাথে করে দ্রুত এগিয়ে গেলেন। কিন্তু কাছে যাওয়ার আগেই হুজুর পাক হঠাৎ উঠে গিয়ে হুজরা শরীফের দরজা বন্ধ করে দিলেন এবং অত্যন্ত গম্ভীর কন্ঠে মাইকে ঘোষণা করলেন, “বরিশালের লঞ্চ কাফেলা বিদায় দিলাম। আপনারা তবারক খেয়ে এখনই লঞ্চ ছেড়ে দিন। আর এরপর থেকে বরিশালের লঞ্চ কাফেলা বাতিল করা হলো। কারণ, এ কাফেলায় আপনাদের অনেক কষ্ট হয়।” আর কেউ বুঝুক আর না বুঝুক পীর কেবলাজানের দীর্ঘদিনের সান্নিধ্যপ্রাপ্ত মুরীদ হাফেজ আব্দুল গণি এ ঘোষণার তাৎপর্য বুঝতে পেরে কাঁদতে কাঁদতে বুক ভাসালেন।