ঢাকা ০৮:৩৮ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২২ মে ২০২৫, ৮ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

আপন ঘরের খবর নে না — লালন গীতি বিশ্লেষণ

  • আপডেট সময় : ০৩:৫৪:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫
  • / ২৪১৪ বার পড়া হয়েছে
Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

** “আপন ঘরের খবর নে না।

অনায়াসে দেখতে পাবি

কোন্‌খানে কার বারাম খানা॥

 

কমল ফোটা কারে বলি

কোন্ মোকাম তার কোথা গলি,

কোন্ সময় প’ড়ে ফুলে,

মধু খায় সে অলি জনা॥

 

অন্য জ্ঞান যার সখ্য মোক্ষ,

সাধকের উপলক্ষ,

অপরূপ তার ব্রহ্ম

দেখলে চক্ষের পাপ থাকে না॥

 

শুষ্ক নদীর সুখ সরোবর,

তিলে তিলে হয় গো সাঁতার,

লালন কয়, কৃতিকর্ম্মার

কি কারখানা॥”**

 

 

 

 

সারমর্ম:

 

লালনের এই গানটি আধ্যাত্মিক আত্ম-অন্বেষণ এবং অন্তর্জগতে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধির প্রতি আহ্বান জানায়। মানুষ বাইরের জগতে ঘুরে বেড়িয়ে ঈশ্বর বা মুক্তির সন্ধান করে, অথচ নিজের ‘আপন ঘর’ অর্থাৎ আত্মার গভীরে তাকায় না। গানে তিনি আত্মজ্ঞান ও আত্মসাধনার মাধ্যমে পরম সত্যে পৌঁছানোর কথা বলেন।

 

আরো পড়ুন:সুফিবাদ ও আত্মদর্শন: আত্মার পরিশুদ্ধি ও আলোর পথ

 

ভেদ তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা:

 

১. “আপন ঘরের খবর নে না…”

 

এখানে “আপন ঘর” বলতে বোঝানো হয়েছে নিজের আত্মা, চৈতন্য বা মনের গভীরতর স্তরকে। লালন বলেন, তুমি বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছ, অথচ নিজের ভেতরে যা আছে তা জানো না। নিজের সত্তা সম্পর্কে সচেতন হলে তুমিই জানতে পারো কোথায় রয়েছে ‘বারামখানা’ — অর্থাৎ ঈশ্বর বা পরমাত্মার আসন।

 

২. “কমল ফোটা কারে বলি…”

 

‘কমল ফুল’ এখানে আত্মিক বিকাশের প্রতীক। এটি কবে ফুটবে, কোথায় ফুটবে, তার ‘মোকাম’ বা ঠিকানা কোথায় — তা সহজে জানা যায় না। যখন আত্মা পরিপক্ক হয়, তখন সেই ‘কমল’ ফোটে, অর্থাৎ চৈতন্য প্রস্ফুটিত হয়। তখনই সাধক হয়ে ওঠে ‘অলি’, যে আত্মার মধু আস্বাদন করতে পারে।

 

৩. “অন্য জ্ঞান যার সখ্য মোক্ষ…”

 

যার বন্ধুত্ব ‘অন্য জ্ঞান’ — অর্থাৎ পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সঙ্গে, সেই পায় মুক্তি (মোক্ষ)। এমন সাধকের জীবনে ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের অপরূপ রূপ ধরা দেয়। সেই দর্শনে দৃষ্টির পাপ বা মোহ বিলীন হয়ে যায়।

 

৪. “শুষ্ক নদীর সুখ সরোবর…”

 

আপাতভাবে শুষ্ক মনে হলেও অন্তরে এক অনন্ত শান্তির সরোবর রয়েছে। ধৈর্য ধরে যদি সাধনা করা যায়, তবে সেই সুখ-সরোবরের সন্ধান মেলে। লালন বলেন, এই দেহ বা সংসারই এক আশ্চর্য কারখানা — যা কর্মের (কৃতিকর্ম্ম) মাধ্যমে আত্ম-অন্বেষণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

 

 

 

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি:

 

এই গানে লালন দেহতত্ত্ব, আত্মজ্ঞানের সাধনা, ব্রহ্মজ্ঞান ও মোক্ষের ধারণা একত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর বাউল দর্শনে ঈশ্বর বাইরের কোনো দেবতা নন, বরং অন্তর্জগতেই তাঁর অবস্থান। গানটি মানুষকে আত্মসচেতনতা ও আত্মসাধনার দিকে আহ্বান করে, বাহ্যিক আড়ম্বর ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

 

“আপন ঘরের খবর নে না” গানে লালন একদিকে যেমন ঈশ্বরের অবস্থানকে দেহমাঝে বা অন্তরে স্থাপন করেন, অন্যদিকে সাধনার মাধ্যমে সেই অবস্থান উপলব্ধির দিকেও পাঠককে অনুপ্রাণিত করেন। গানটি আত্ম-অনুসন্ধান, দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক মুক্তির এক অনুপম নিদর্শন — যা যুগ যুগ ধরে ভাববাদী সাধকদের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে।

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

আপন ঘরের খবর নে না — লালন গীতি বিশ্লেষণ

আপডেট সময় : ০৩:৫৪:২৮ অপরাহ্ন, রবিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৫

** “আপন ঘরের খবর নে না।

অনায়াসে দেখতে পাবি

কোন্‌খানে কার বারাম খানা॥

 

কমল ফোটা কারে বলি

কোন্ মোকাম তার কোথা গলি,

কোন্ সময় প’ড়ে ফুলে,

মধু খায় সে অলি জনা॥

 

অন্য জ্ঞান যার সখ্য মোক্ষ,

সাধকের উপলক্ষ,

অপরূপ তার ব্রহ্ম

দেখলে চক্ষের পাপ থাকে না॥

 

শুষ্ক নদীর সুখ সরোবর,

তিলে তিলে হয় গো সাঁতার,

লালন কয়, কৃতিকর্ম্মার

কি কারখানা॥”**

 

 

 

 

সারমর্ম:

 

লালনের এই গানটি আধ্যাত্মিক আত্ম-অন্বেষণ এবং অন্তর্জগতে ঈশ্বরের উপস্থিতি উপলব্ধির প্রতি আহ্বান জানায়। মানুষ বাইরের জগতে ঘুরে বেড়িয়ে ঈশ্বর বা মুক্তির সন্ধান করে, অথচ নিজের ‘আপন ঘর’ অর্থাৎ আত্মার গভীরে তাকায় না। গানে তিনি আত্মজ্ঞান ও আত্মসাধনার মাধ্যমে পরম সত্যে পৌঁছানোর কথা বলেন।

 

আরো পড়ুন:সুফিবাদ ও আত্মদর্শন: আত্মার পরিশুদ্ধি ও আলোর পথ

 

ভেদ তত্ত্ব ও ব্যাখ্যা:

 

১. “আপন ঘরের খবর নে না…”

 

এখানে “আপন ঘর” বলতে বোঝানো হয়েছে নিজের আত্মা, চৈতন্য বা মনের গভীরতর স্তরকে। লালন বলেন, তুমি বাইরে খুঁজে বেড়াচ্ছ, অথচ নিজের ভেতরে যা আছে তা জানো না। নিজের সত্তা সম্পর্কে সচেতন হলে তুমিই জানতে পারো কোথায় রয়েছে ‘বারামখানা’ — অর্থাৎ ঈশ্বর বা পরমাত্মার আসন।

 

২. “কমল ফোটা কারে বলি…”

 

‘কমল ফুল’ এখানে আত্মিক বিকাশের প্রতীক। এটি কবে ফুটবে, কোথায় ফুটবে, তার ‘মোকাম’ বা ঠিকানা কোথায় — তা সহজে জানা যায় না। যখন আত্মা পরিপক্ক হয়, তখন সেই ‘কমল’ ফোটে, অর্থাৎ চৈতন্য প্রস্ফুটিত হয়। তখনই সাধক হয়ে ওঠে ‘অলি’, যে আত্মার মধু আস্বাদন করতে পারে।

 

৩. “অন্য জ্ঞান যার সখ্য মোক্ষ…”

 

যার বন্ধুত্ব ‘অন্য জ্ঞান’ — অর্থাৎ পারমার্থিক বা আধ্যাত্মিক জ্ঞানের সঙ্গে, সেই পায় মুক্তি (মোক্ষ)। এমন সাধকের জীবনে ব্রহ্মের বা ঈশ্বরের অপরূপ রূপ ধরা দেয়। সেই দর্শনে দৃষ্টির পাপ বা মোহ বিলীন হয়ে যায়।

 

৪. “শুষ্ক নদীর সুখ সরোবর…”

 

আপাতভাবে শুষ্ক মনে হলেও অন্তরে এক অনন্ত শান্তির সরোবর রয়েছে। ধৈর্য ধরে যদি সাধনা করা যায়, তবে সেই সুখ-সরোবরের সন্ধান মেলে। লালন বলেন, এই দেহ বা সংসারই এক আশ্চর্য কারখানা — যা কর্মের (কৃতিকর্ম্ম) মাধ্যমে আত্ম-অন্বেষণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠে।

 

 

 

দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গি:

 

এই গানে লালন দেহতত্ত্ব, আত্মজ্ঞানের সাধনা, ব্রহ্মজ্ঞান ও মোক্ষের ধারণা একত্রে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর বাউল দর্শনে ঈশ্বর বাইরের কোনো দেবতা নন, বরং অন্তর্জগতেই তাঁর অবস্থান। গানটি মানুষকে আত্মসচেতনতা ও আত্মসাধনার দিকে আহ্বান করে, বাহ্যিক আড়ম্বর ও ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকে মুক্তির পথ দেখায়।

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

 

“আপন ঘরের খবর নে না” গানে লালন একদিকে যেমন ঈশ্বরের অবস্থানকে দেহমাঝে বা অন্তরে স্থাপন করেন, অন্যদিকে সাধনার মাধ্যমে সেই অবস্থান উপলব্ধির দিকেও পাঠককে অনুপ্রাণিত করেন। গানটি আত্ম-অনুসন্ধান, দেহতত্ত্ব ও আধ্যাত্মিক মুক্তির এক অনুপম নিদর্শন — যা যুগ যুগ ধরে ভাববাদী সাধকদের পথপ্রদর্শক হয়ে আছে।