ঢাকা ০৬:৩৩ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

  • আপডেট সময় : ১২:৪৪:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫
  • / ২৪০৬ বার পড়া হয়েছে

লালনগীতি: "আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে"—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

 

বাংলার সুফি-সাধক লালন সাঁইজি তাঁর গানের মাধ্যমে মানুষের দেহতত্ত্ব, আত্মজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে” গানটিও এমন এক দর্শন বহন করে, যেখানে মানবদেহকে আধ্যাত্মিকভাবে ‘মক্কা’ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই গানে লালন মানুষকে বাইরের তীর্থযাত্রা ও বাহ্যিক রীতিনীতির চেয়ে আত্মজ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে চেয়েছেন।

 

গানের মর্মকথা

লালন এখানে দেহতত্ত্বের এক গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইসলামী ভাবধারার অনুসরণ করে মক্কাকে পবিত্রতম স্থান হিসেবে ধরা হয়, যেখানে হজ পালন করা হয়। কিন্তু লালন মনে করেন, প্রকৃত মক্কা বা পবিত্র স্থান মানুষের অন্তরের গভীরে, আত্মার মাঝে লুকিয়ে আছে। বাহ্যিকভাবে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে, কঠোর তীর্থযাত্রা করে কোনো লাভ নেই যদি মানুষ নিজের ভেতরের সত্যকে উপলব্ধি করতে না পারে।

আরো পড়ুন:মারফতের গোপন রহস্য: সত্যের সন্ধানে আত্মার যাত্রা

তিনি বলেন, মহান স্রষ্টা এক অপার কুদরতে এই মানবদেহ নামক “মক্কা” নির্মাণ করেছেন, যেখানে তিনি নিজে অবস্থান করেন। দেহের চার পাশে চারজন নূরের ইমামের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে, যা চার খলিফা (হজরত আবু বকর, হজরত উমর, হজরত উসমান ও হজরত আলী) অথবা চার মৌলিক শক্তিকে নির্দেশ করতে পারে। এই দেহ-মক্কার মধ্যস্থলে ‘সাঁই’ বা পরম সত্যের অবস্থান।

 

লালন বিশ্বাস করেন, প্রকৃত তীর্থ বা হজ হলো আত্মার সাথে সৃষ্টিকর্তার মিলন। এই মিলন ঘটে দেহ-মক্কার গভীরে, যেখানে আত্মজ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত মুক্তি লাভ করতে পারে।

 

গানের ব্যাখ্যা

১. আত্মদর্শন ও মানবদেহের গুরুত্ব

গানের প্রথম দুটি চরণ:

“আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে

দেখনা রে মন ভেয়ে।”

 

এখানে লালন বলেন, আত্মদর্শনের মধ্যেই প্রকৃত মক্কার সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষের শরীরই এক পবিত্র উপাসনালয়, যেখানে সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান। তাই বাহ্যিকভাবে কোথাও ছুটোছুটি না করে নিজ দেহ ও আত্মার মাঝে তাকানো উচিত।

 

২. বাহ্যিক তীর্থযাত্রার প্রতি প্রশ্ন

“দেশ-দেশান্তরে দৌড়ে এবার

মরছো কেন হাঁফিয়ে॥”

 

লালন এখানে মানুষের বাহ্যিকতাপূর্ণ ধর্মাচারের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক মানুষ বাইরের আচার-অনুষ্ঠানে এতটাই মগ্ন থাকে যে, তারা নিজের আত্মাকে চেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

 

৩. দেহ-মক্কার গঠন ও রহস্য

“ক’রে অতি আজব হক্কা

গঠেছে সেই মানুষ-মক্কা

কুদরতি নূর দিয়ে।”

 

এখানে তিনি বলেন, মহান স্রষ্টা এক অলৌকিক ক্ষমতায় এই দেহ-মক্কা সৃষ্টি করেছেন, যা কুদরতি নূর বা জ্যোতির দ্বারা গঠিত। এই দেহের মধ্যেই আত্মিক জ্ঞানের সমস্ত গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।

 

“ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম

মধ্যে সাঁই বসিয়ে॥”

 

চার নূরের ইমাম বলতে তিনি চার খলিফা অথবা চার মৌলিক শক্তির কথা বলেছেন। আর সাঁই বা ঈশ্বর এই মক্কার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ, আমাদের হৃদয়ের গভীরে ঈশ্বরের অবস্থান।

 

 

৪. আধ্যাত্মিক তীর্থযাত্রা ও আত্মজ্ঞান

“তিল-প্রমাণ জায়গার ভিতর

বানিয়েছে সাঁই ঊর্ধ্ব শহর

এই মানুষ-মক্কায়ে।”

 

এখানে “তিল-প্রমাণ জায়গা” বলতে হয়তো ভ্রূমধ্যস্থ চক্র (আজ্ঞান চক্র) বা হৃদয়কেন্দ্রকে বোঝানো হয়েছে। যেখানে আধ্যাত্মিক জ্ঞান উদ্ভাসিত হয় এবং মানুষ পরম সত্যের সাথে মিলিত হয়।

 

“মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ

উঠছে রে আজগুবি আওয়াজ

সাত তালা ভেদিয়ে।”

 

সাত তালা বলতে সাত আধ্যাত্মিক স্তর বোঝানো হতে পারে, যা সাত আকাশ বা সপ্তচক্রের প্রতীক। আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের মাধ্যমে একজন সাধক এই স্তরগুলো অতিক্রম করে চূড়ান্ত মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়।

 

৫. দশদুয়ারী দেহ ও আত্মজ্ঞান

“আছে সিংদরজা দশদুয়ারী,

এ নাম নিদ্রা-ত্যাগ হ’য়ে নূরী।”

 

দশদুয়ারী বলতে দেহের দশটি ইন্দ্রিয়কে বোঝানো হয়েছে। এই ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যদি আত্মজ্ঞান লাভ করে, তবে সে প্রকৃত নূরের সন্ধান পায়।

“মানুষ-মক্কা মুরশিদ-পদে

ডুবে দেখগা ধাক্কা সামলিয়ে।”

 

লালন বলেন, একজন প্রকৃত মুরশিদ বা আধ্যাত্মিক গুরুই পারে মানুষের দেহ-মক্কার সত্যটি উন্মোচন করে দিতে। তাই তাকে যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত।

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

লালন এই গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক আত্মদর্শনের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। বাহ্যিক তীর্থযাত্রা, আনুষ্ঠানিক ধর্মাচারের পরিবর্তে তিনি অন্তর্জগতের অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত মক্কা মানুষের দেহের ভেতরেই আছে, যেখানে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব। আত্মজ্ঞান অর্জন, মুরশিদের সান্নিধ্য গ্রহণ এবং আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ পরম সত্যের সাথে মিলিত হতে পারে।

 

এই গানের ভাবার্থ কেবল ধর্মীয় নয়, বরং দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক। এটি সমস্ত মানুষের জন্য এক অভিন্ন বার্তা বহন করে—নিজের ভিতরে তাকাও, নিজের সত্যকে জানো, এবং নিজের আত্মাকে চেনার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তি লাভ করো।

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

আপডেট সময় : ১২:৪৪:২৯ অপরাহ্ন, শনিবার, ১৫ মার্চ ২০২৫

লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

 

বাংলার সুফি-সাধক লালন সাঁইজি তাঁর গানের মাধ্যমে মানুষের দেহতত্ত্ব, আত্মজ্ঞান ও আধ্যাত্মিকতার গভীর রহস্য উদ্ঘাটন করেছেন। “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে” গানটিও এমন এক দর্শন বহন করে, যেখানে মানবদেহকে আধ্যাত্মিকভাবে ‘মক্কা’ রূপে কল্পনা করা হয়েছে। এই গানে লালন মানুষকে বাইরের তীর্থযাত্রা ও বাহ্যিক রীতিনীতির চেয়ে আত্মজ্ঞান অর্জনের গুরুত্ব অনুধাবন করাতে চেয়েছেন।

 

গানের মর্মকথা

লালন এখানে দেহতত্ত্বের এক গভীর ব্যাখ্যা দিয়েছেন। ইসলামী ভাবধারার অনুসরণ করে মক্কাকে পবিত্রতম স্থান হিসেবে ধরা হয়, যেখানে হজ পালন করা হয়। কিন্তু লালন মনে করেন, প্রকৃত মক্কা বা পবিত্র স্থান মানুষের অন্তরের গভীরে, আত্মার মাঝে লুকিয়ে আছে। বাহ্যিকভাবে দেশ-দেশান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে, কঠোর তীর্থযাত্রা করে কোনো লাভ নেই যদি মানুষ নিজের ভেতরের সত্যকে উপলব্ধি করতে না পারে।

আরো পড়ুন:মারফতের গোপন রহস্য: সত্যের সন্ধানে আত্মার যাত্রা

তিনি বলেন, মহান স্রষ্টা এক অপার কুদরতে এই মানবদেহ নামক “মক্কা” নির্মাণ করেছেন, যেখানে তিনি নিজে অবস্থান করেন। দেহের চার পাশে চারজন নূরের ইমামের উপস্থিতির কথা বলা হয়েছে, যা চার খলিফা (হজরত আবু বকর, হজরত উমর, হজরত উসমান ও হজরত আলী) অথবা চার মৌলিক শক্তিকে নির্দেশ করতে পারে। এই দেহ-মক্কার মধ্যস্থলে ‘সাঁই’ বা পরম সত্যের অবস্থান।

 

লালন বিশ্বাস করেন, প্রকৃত তীর্থ বা হজ হলো আত্মার সাথে সৃষ্টিকর্তার মিলন। এই মিলন ঘটে দেহ-মক্কার গভীরে, যেখানে আত্মজ্ঞান ও ভক্তির মাধ্যমে মানুষ প্রকৃত মুক্তি লাভ করতে পারে।

 

গানের ব্যাখ্যা

১. আত্মদর্শন ও মানবদেহের গুরুত্ব

গানের প্রথম দুটি চরণ:

“আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে

দেখনা রে মন ভেয়ে।”

 

এখানে লালন বলেন, আত্মদর্শনের মধ্যেই প্রকৃত মক্কার সন্ধান পাওয়া যায়। মানুষের শরীরই এক পবিত্র উপাসনালয়, যেখানে সৃষ্টিকর্তা বিদ্যমান। তাই বাহ্যিকভাবে কোথাও ছুটোছুটি না করে নিজ দেহ ও আত্মার মাঝে তাকানো উচিত।

 

২. বাহ্যিক তীর্থযাত্রার প্রতি প্রশ্ন

“দেশ-দেশান্তরে দৌড়ে এবার

মরছো কেন হাঁফিয়ে॥”

 

লালন এখানে মানুষের বাহ্যিকতাপূর্ণ ধর্মাচারের প্রতি প্রশ্ন তুলেছেন। অনেক মানুষ বাইরের আচার-অনুষ্ঠানে এতটাই মগ্ন থাকে যে, তারা নিজের আত্মাকে চেনার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে না।

 

৩. দেহ-মক্কার গঠন ও রহস্য

“ক’রে অতি আজব হক্কা

গঠেছে সেই মানুষ-মক্কা

কুদরতি নূর দিয়ে।”

 

এখানে তিনি বলেন, মহান স্রষ্টা এক অলৌকিক ক্ষমতায় এই দেহ-মক্কা সৃষ্টি করেছেন, যা কুদরতি নূর বা জ্যোতির দ্বারা গঠিত। এই দেহের মধ্যেই আত্মিক জ্ঞানের সমস্ত গোপন রহস্য লুকিয়ে আছে।

 

“ও তার চার দ্বারে চার নূরের ইমাম

মধ্যে সাঁই বসিয়ে॥”

 

চার নূরের ইমাম বলতে তিনি চার খলিফা অথবা চার মৌলিক শক্তির কথা বলেছেন। আর সাঁই বা ঈশ্বর এই মক্কার কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করছেন। অর্থাৎ, আমাদের হৃদয়ের গভীরে ঈশ্বরের অবস্থান।

 

 

৪. আধ্যাত্মিক তীর্থযাত্রা ও আত্মজ্ঞান

“তিল-প্রমাণ জায়গার ভিতর

বানিয়েছে সাঁই ঊর্ধ্ব শহর

এই মানুষ-মক্কায়ে।”

 

এখানে “তিল-প্রমাণ জায়গা” বলতে হয়তো ভ্রূমধ্যস্থ চক্র (আজ্ঞান চক্র) বা হৃদয়কেন্দ্রকে বোঝানো হয়েছে। যেখানে আধ্যাত্মিক জ্ঞান উদ্ভাসিত হয় এবং মানুষ পরম সত্যের সাথে মিলিত হয়।

 

“মানুষ-মক্কা কুদরতি কাজ

উঠছে রে আজগুবি আওয়াজ

সাত তালা ভেদিয়ে।”

 

সাত তালা বলতে সাত আধ্যাত্মিক স্তর বোঝানো হতে পারে, যা সাত আকাশ বা সপ্তচক্রের প্রতীক। আধ্যাত্মিক উন্নতি লাভের মাধ্যমে একজন সাধক এই স্তরগুলো অতিক্রম করে চূড়ান্ত মুক্তির দিকে এগিয়ে যায়।

 

৫. দশদুয়ারী দেহ ও আত্মজ্ঞান

“আছে সিংদরজা দশদুয়ারী,

এ নাম নিদ্রা-ত্যাগ হ’য়ে নূরী।”

 

দশদুয়ারী বলতে দেহের দশটি ইন্দ্রিয়কে বোঝানো হয়েছে। এই ইন্দ্রিয়ের দাসত্ব থেকে মুক্ত হয়ে মানুষ যদি আত্মজ্ঞান লাভ করে, তবে সে প্রকৃত নূরের সন্ধান পায়।

“মানুষ-মক্কা মুরশিদ-পদে

ডুবে দেখগা ধাক্কা সামলিয়ে।”

 

লালন বলেন, একজন প্রকৃত মুরশিদ বা আধ্যাত্মিক গুরুই পারে মানুষের দেহ-মক্কার সত্যটি উন্মোচন করে দিতে। তাই তাকে যথাযথভাবে অনুসরণ করা উচিত।

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

লালন এই গানের মাধ্যমে আধ্যাত্মিক আত্মদর্শনের তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। বাহ্যিক তীর্থযাত্রা, আনুষ্ঠানিক ধর্মাচারের পরিবর্তে তিনি অন্তর্জগতের অনুসন্ধানের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে, প্রকৃত মক্কা মানুষের দেহের ভেতরেই আছে, যেখানে স্রষ্টার সান্নিধ্য লাভ সম্ভব। আত্মজ্ঞান অর্জন, মুরশিদের সান্নিধ্য গ্রহণ এবং আধ্যাত্মিক চেতনার বিকাশের মাধ্যমেই মানুষ পরম সত্যের সাথে মিলিত হতে পারে।

 

এই গানের ভাবার্থ কেবল ধর্মীয় নয়, বরং দার্শনিক ও আধ্যাত্মিক। এটি সমস্ত মানুষের জন্য এক অভিন্ন বার্তা বহন করে—নিজের ভিতরে তাকাও, নিজের সত্যকে জানো, এবং নিজের আত্মাকে চেনার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তি লাভ করো।