ঢাকা ০৮:১১ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৫, ১১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

ও যার আপন খবর, আপনার হয় না—সুফিবাদ ও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা

  • আপডেট সময় : ০১:৪৭:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫
  • / ২৪০৭ বার পড়া হয়েছে
Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

“ও যার আপন খবর, আপনার হয় না”—এই কথার গভীর তাৎপর্য রয়েছে সুফিবাদ ও ইসলামী আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায়। এটি মূলত আত্ম-অনুসন্ধান, আত্মপরিচয় ও আধ্যাত্মিক জাগরণের দিকে ইঙ্গিত করে। ইসলাম ও সুফিবাদের মূল লক্ষ্য হলো আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা। এই গানটি সেই পথেরই নির্দেশনা দেয়, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পারলে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পায়।

 

আরো পড়ুন:সূফি সাধনায় ফানা ও বাকা পরিচয়

 

সুফিবাদে আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব

 

সুফিবাদে বলা হয়, “যে নিজেকে চিনে, সে তার রবকেও চিনে” (مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ)। অর্থাৎ, আত্মপরিচয়ের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারে।

 

গানের মূল ভাবনাটি এই শিক্ষার সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ।

 

“ও যার আপন খবর, আপনার হয় না”

→ অর্থাৎ, মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানে না। সে দুনিয়ার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে, নিজের আত্মার প্রকৃতি, নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সম্পর্কে অজ্ঞান থাকে।

 

“একবার আপনারে চিনতে পারলে রে… যাবে অচেনারে চেনা”

→ যদি কেউ নিজের অস্তিত্বের রহস্য বুঝতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যাবতীয় বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে, এবং সে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে। “অচেনা” বলতে এখানে পরম সত্তা, অর্থাৎ আল্লাহর প্রকৃত জ্ঞান ও উপলব্ধিকে বোঝানো হয়েছে।

 

আরো পড়ুন:“জাগ্রত পরাণ যার মরে না সে জন”— আধ্যাত্মিকতার চিরন্তন সত্য

 

ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মপরিচয় ও আত্মশুদ্ধি

ইসলামে আত্মপরিচয় ও আত্মশুদ্ধিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে।

 

১. আল-কুরআনে আত্ম-অনুসন্ধানের আহ্বান

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“আমি তাদেরকে দিগন্তে ও তাদের নিজেদের মধ্যেও আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো, যতক্ষণ না তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটিই সত্য।” (সূরা ফুসসিলাত: ৫৩)

 

→ এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সত্যকে খুঁজতে হলে নিজের মধ্যেও তাকাতে হবে। ব্যক্তি যখন আত্মিক জ্ঞান অর্জন করবে, তখনই আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলী সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে।

 

 

২. আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ

“যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো, সে সফলকাম হলো। আর যে নিজেকে কলুষিত করলো, সে ব্যর্থ হলো।” (সূরা আশ-শামস: ৯-১০)

 

→ নিজেকে চিনতে হলে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই ব্যক্তি তার রবের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারে।

 

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

 

গানের সাথে সুফিবাদের মিল

সুফিবাদ মূলত আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। এই গানের ভাবার্থের সাথে সুফিদের শিক্ষার মিল রয়েছে:

 

১. “আপনার খবর” – আত্মজ্ঞান ও আত্মপরিচয়

→ সুফিবাদ বলে, আত্মজ্ঞান অর্জন না করলে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্ব ও রহস্য উপলব্ধি করতে পারে না। নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চেনা সম্ভব হয়।

 

২. “অচেনারে চেনা” – মারেফাতের জ্ঞান

→ সুফিবাদে ‘মারেফাত’ বা গহীন আত্মিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অদৃশ্য সত্যকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। যখন কেউ আত্মার গভীরে প্রবেশ করে, তখন সে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ উপলব্ধি করতে পারে।

 

সুফি দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা

 

এই গানের বার্তা সুফিদের বিখ্যাত উক্তিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ:

মাওলানা রুমি বলেন:

“তুমি নিজেকে এক বিন্দু মনে করো, অথচ তোমার ভেতরে এক মহাসাগর লুকিয়ে আছে।”

→ অর্থাৎ, ব্যক্তি নিজের প্রকৃত সত্তা বুঝতে পারলে, সে আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও দয়াকে উপলব্ধি করতে পারবে।

 

বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বলেন:

“আমি যখন আমার ‘আমি’কে চিনলাম, তখন আমি দেখলাম আমার ভেতরেই আল্লাহর নূর বিদ্যমান।”

→ এই কথার মূল ভাব অর্থাৎ নিজেকে চিনতে পারলে ব্যক্তি সত্যের সন্ধান পাবে, যা এই গানের মূল বক্তব্যের সাথেও মিলে যায়।

 

আরো পড়ুন:লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

 

এই গানটি শুধু একটি সঙ্গীত নয়, বরং গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেয়। এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে এবং আল্লাহর পথে আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানায়।

 

ইসলাম ও সুফিবাদ—উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গানটির মূল বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি নিজের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারবে, সে সত্যের সন্ধান পাবে এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠতার আনন্দ অনুভব করবে।

 

আরো পড়ুন:গাজার বিজয় ও ইসরায়েলের পতন: কুরআন, হাদিস ও মানবদৃষ্টিতে বিশ্লেষণ

 

নিজেকে চেনাই প্রকৃত জ্ঞান। নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা আলোকে খুঁজে পাওয়া মানেই আল্লাহর রহস্যময় সত্তাকে উপলব্ধি করা। তাই আমাদের উচিত আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি সাধন করা, যেন আমরা সত্যকে চিনতে পারি এবং আমাদের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারি।

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

ও যার আপন খবর, আপনার হয় না—সুফিবাদ ও ইসলামি দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা

আপডেট সময় : ০১:৪৭:১০ অপরাহ্ন, শনিবার, ২২ মার্চ ২০২৫

“ও যার আপন খবর, আপনার হয় না”—এই কথার গভীর তাৎপর্য রয়েছে সুফিবাদ ও ইসলামী আধ্যাত্মিক চিন্তাধারায়। এটি মূলত আত্ম-অনুসন্ধান, আত্মপরিচয় ও আধ্যাত্মিক জাগরণের দিকে ইঙ্গিত করে। ইসলাম ও সুফিবাদের মূল লক্ষ্য হলো আত্মার পরিশুদ্ধি এবং আল্লাহর সান্নিধ্য লাভ করা। এই গানটি সেই পথেরই নির্দেশনা দেয়, যেখানে ব্যক্তি নিজেকে চিনতে পারলে প্রকৃত সত্যের সন্ধান পায়।

 

আরো পড়ুন:সূফি সাধনায় ফানা ও বাকা পরিচয়

 

সুফিবাদে আত্ম-অনুসন্ধান ও আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব

 

সুফিবাদে বলা হয়, “যে নিজেকে চিনে, সে তার রবকেও চিনে” (مَنْ عَرَفَ نَفْسَهُ فَقَدْ عَرَفَ رَبَّهُ)। অর্থাৎ, আত্মপরিচয়ের মাধ্যমেই মানুষ আল্লাহর সান্নিধ্যে পৌঁছতে পারে।

 

গানের মূল ভাবনাটি এই শিক্ষার সাথেই সঙ্গতিপূর্ণ।

 

“ও যার আপন খবর, আপনার হয় না”

→ অর্থাৎ, মানুষ নিজের প্রকৃত স্বরূপ সম্পর্কে জানে না। সে দুনিয়ার মোহে এতটাই আচ্ছন্ন থাকে যে, নিজের আত্মার প্রকৃতি, নিজের সৃষ্টির উদ্দেশ্য এবং আল্লাহর সাথে সম্পর্ক সম্পর্কে অজ্ঞান থাকে।

 

“একবার আপনারে চিনতে পারলে রে… যাবে অচেনারে চেনা”

→ যদি কেউ নিজের অস্তিত্বের রহস্য বুঝতে পারে, তাহলে দুনিয়ার যাবতীয় বিভ্রান্তি দূর হয়ে যাবে, এবং সে সত্যকে উপলব্ধি করতে পারবে। “অচেনা” বলতে এখানে পরম সত্তা, অর্থাৎ আল্লাহর প্রকৃত জ্ঞান ও উপলব্ধিকে বোঝানো হয়েছে।

 

আরো পড়ুন:“জাগ্রত পরাণ যার মরে না সে জন”— আধ্যাত্মিকতার চিরন্তন সত্য

 

ইসলামের দৃষ্টিতে আত্মপরিচয় ও আত্মশুদ্ধি

ইসলামে আত্মপরিচয় ও আত্মশুদ্ধিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে করা হয়েছে।

 

১. আল-কুরআনে আত্ম-অনুসন্ধানের আহ্বান

আল্লাহ তাআলা বলেন:

“আমি তাদেরকে দিগন্তে ও তাদের নিজেদের মধ্যেও আমার নিদর্শনসমূহ দেখাবো, যতক্ষণ না তাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে যায় যে, এটিই সত্য।” (সূরা ফুসসিলাত: ৫৩)

 

→ এখানে স্পষ্ট বলা হয়েছে, সত্যকে খুঁজতে হলে নিজের মধ্যেও তাকাতে হবে। ব্যক্তি যখন আত্মিক জ্ঞান অর্জন করবে, তখনই আল্লাহর অস্তিত্ব ও গুণাবলী সম্পর্কে গভীর উপলব্ধি অর্জন করতে পারবে।

 

 

২. আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ

“যে নিজেকে পরিশুদ্ধ করলো, সে সফলকাম হলো। আর যে নিজেকে কলুষিত করলো, সে ব্যর্থ হলো।” (সূরা আশ-শামস: ৯-১০)

 

→ নিজেকে চিনতে হলে আত্মশুদ্ধি করতে হবে। আত্মশুদ্ধির মাধ্যমেই ব্যক্তি তার রবের প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে পারে।

 

 

আরো পড়ুন:“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি”—ইসলাম ও সুফিবাদের আলোকে ব্যাখ্যা

 

গানের সাথে সুফিবাদের মিল

সুফিবাদ মূলত আত্মার পরিশুদ্ধি ও আল্লাহর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার শিক্ষা দেয়। এই গানের ভাবার্থের সাথে সুফিদের শিক্ষার মিল রয়েছে:

 

১. “আপনার খবর” – আত্মজ্ঞান ও আত্মপরিচয়

→ সুফিবাদ বলে, আত্মজ্ঞান অর্জন না করলে ব্যক্তি আল্লাহর অস্তিত্ব ও রহস্য উপলব্ধি করতে পারে না। নিজেকে চেনার মাধ্যমে আল্লাহকে চেনা সম্ভব হয়।

 

২. “অচেনারে চেনা” – মারেফাতের জ্ঞান

→ সুফিবাদে ‘মারেফাত’ বা গহীন আত্মিক জ্ঞান অর্জনের মাধ্যমে অদৃশ্য সত্যকে বোঝার চেষ্টা করা হয়। যখন কেউ আত্মার গভীরে প্রবেশ করে, তখন সে আল্লাহর অস্তিত্বের প্রমাণ উপলব্ধি করতে পারে।

 

সুফি দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা

 

এই গানের বার্তা সুফিদের বিখ্যাত উক্তিগুলোর সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ:

মাওলানা রুমি বলেন:

“তুমি নিজেকে এক বিন্দু মনে করো, অথচ তোমার ভেতরে এক মহাসাগর লুকিয়ে আছে।”

→ অর্থাৎ, ব্যক্তি নিজের প্রকৃত সত্তা বুঝতে পারলে, সে আল্লাহর অসীম জ্ঞান ও দয়াকে উপলব্ধি করতে পারবে।

 

বায়েজিদ বোস্তামি (রহ.) বলেন:

“আমি যখন আমার ‘আমি’কে চিনলাম, তখন আমি দেখলাম আমার ভেতরেই আল্লাহর নূর বিদ্যমান।”

→ এই কথার মূল ভাব অর্থাৎ নিজেকে চিনতে পারলে ব্যক্তি সত্যের সন্ধান পাবে, যা এই গানের মূল বক্তব্যের সাথেও মিলে যায়।

 

আরো পড়ুন:লালনগীতি: “আছে আদি মক্কা এই মানবদেহে”—এর মর্মকথা ও ব্যাখ্যা

 

এই গানটি শুধু একটি সঙ্গীত নয়, বরং গভীর আধ্যাত্মিক শিক্ষা দেয়। এটি আমাদের আত্মপরিচয়ের গুরুত্ব বুঝতে সাহায্য করে এবং আল্লাহর পথে আত্মশুদ্ধির আহ্বান জানায়।

 

ইসলাম ও সুফিবাদ—উভয় দৃষ্টিকোণ থেকেই গানটির মূল বার্তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে ব্যক্তি নিজের আত্মার প্রকৃত স্বরূপ বুঝতে পারবে, সে সত্যের সন্ধান পাবে এবং আল্লাহর ঘনিষ্ঠতার আনন্দ অনুভব করবে।

 

আরো পড়ুন:গাজার বিজয় ও ইসরায়েলের পতন: কুরআন, হাদিস ও মানবদৃষ্টিতে বিশ্লেষণ

 

নিজেকে চেনাই প্রকৃত জ্ঞান। নিজের ভেতর লুকিয়ে থাকা আলোকে খুঁজে পাওয়া মানেই আল্লাহর রহস্যময় সত্তাকে উপলব্ধি করা। তাই আমাদের উচিত আত্মশুদ্ধির মাধ্যমে আত্মিক উন্নতি সাধন করা, যেন আমরা সত্যকে চিনতে পারি এবং আমাদের অস্তিত্বের মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করতে পারি।