ঢাকা ০২:০৪ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ০৬ ডিসেম্বর ২০২৪, ২২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের নামাজ ৫ম পর্ব

পাপ এবং পুণ্য যেই নেক আমলে নিহিত তার নাম ‘ছালাত’

শেখ আলহাজ্ব উদ্দিন
  • আপডেট সময় : ০৯:৪২:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
  • / ২৪৪২ বার পড়া হয়েছে
Sufibad.com - সূফিবাদ.কম অনলাইনের সর্বশেষ লেখা পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

 

যেই আমল করলে পুণ্য, না করলে পাপ এ রকম এবাদত অসংখ্য। যেমন রোজা, হজ্জ, ওয়াজেব ও সুন্নতে মোয়াক্কাদা মূলক এবাদত সমূহ ইত্যদি। করলে পুণ্য না করলে পাপ নেই, যেমন সুন্নতে যায়েদা, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য একটি দায়েমী ইবাদত যা করলে পুণ্য, না করলে পাপ। শুধু তাই নয়, বরং যথাযথ নিয়মে সেই আমলটি করতে ব্যর্থ হলে তাতে পুণ্য তো হবেই না, আরো কঠিন পাপ হবে। যেমন ছালাত নামক ইবাদত। ছালাত দায়েমী ফরজ। ছালাত অর্থাৎ নামাজ কায়েম করতে হবে। হাদীসে এসেছে- ছালাত দ্বীনের স্তম্ভ। এই নামাজ কায়েম করতে হবে, ‘পড়া’ নয়। পবিত্র কুরআনে নামাজ কায়েম করতে হবে এই নির্দেশ এসেছে। ‘আদায় করা’ বা ‘নামাজ পড়া’ ইহা কুরআনের শব্দ নয়। বরং প্রচলিত অর্থের ব্যবহৃতরূপ। উপরন্তু এই প্রচলিত অর্থ মোতাবেকই নামাজ আদায় বা নামাজ পড়া হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ‘কায়েম’ করা হচ্ছে না এবং কায়েম করার কাইফিতয়াত কি, তার বাস্তব প্রশিক্ষণও নেই। অথচ নামাজ দায়েমী ফরজ। এই দায়েমী ফরজকে সময়ের উপর ভিত্তি করে ‘আদায়’ বা ‘পড়া’ দ্বারা ‘দ্বায়েমী’ ও ‘কায়েম’ যেন ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ‘হিতে বিপরীত’ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বা বিপরীত ঘটতেছে বা ঘটে চলেছে। পরিণামে কতিপয় (যার যেমন ইচ্ছা) সুন্নত দায়েমী হয়েছে। দায়েমী ফরজ যেন আদায় ও পড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে।

 

পক্ষান্তরে পরিতাপের সাথে অন্তর নিংড়িয়ে আক্ষেপ আসে- হায়রে সমাজ! হায়রে ঘুনে ধরা আলেম সমাজ! হায়রে ফতুয়াবাজের দল! ইসলাম কি বাস্ত বতার বিপরীত? পবিত্র কুরআনের বাস্তবতা ভুলে বা ভুলিয়ে দিয়ে প্রচলিত অর্থে দায়েমী ফরজকে ফল শূণ্য ইবাদতে পরিণত করা হয়েছে।

 

মূলত নামাজ যেমন কায়েম করতে হবে তেমনি কায়েমের মাধ্যমে দায়েমে পরিণত হয়ে এই নামাজ নামাজীকে পাপের পথ থেকে ফিরাবে। মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখার অস্ত্র নামাজ। নফসে আম্মারা দুনিয়ামুখী। পার্থিব জগতের চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, আনন্দ উৎসব, বা সেক্সুয়াল বাধ্যগত উদগ্রীবতার নেশা। অর্থাৎ পার্থিব যে কোন মোহ- মুগ্ধতা মানব মন থেকে ধীরে ধীরে মিটিয়ে দেযার বা খোদায়ী বিধান মোতাবেক জাগতিক সুখভিলাস ভোগ করার মনস্তাত্মিকতা বা মন তৈরি করার আল্লাহর অস্ত্র ‘নামাজ’। ইহা আল্লাহর ঘোষণা। যার উপরে কোন ফতুয়া বা যুক্তি বা দলিল চলে না। আল্লাহ বলেছেন-

 

‎‫إِنَّ الصَّلَوَةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ (عَنْكَبُوت – (১৫)‬‎

 

উচ্চারণ: ইন্নাচ্ছালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ে অল মুনকার। “নিশ্চয়ই নামায মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।”

 

বর্ণিত আয়াতের স্পষ্ট ঘোষণা নামাজী খারাপ কাজ করতে পারে না। বস্তুত মানুষকে পাপের পথ থেকে তাকিদ করে, প্রসার দিয়ে, জোর করে শারীরিক নির্যাতন দিয়ে ফিরানো যাবে না। এখানেও আল্লাহও নির্দেশ لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ )লাইকরাহা ফিদদ্বীন)। “ধর্মের মধ্যে কোন জোর জরদস্তি নেই” (সূরায় বাকারাহ-২৫৬) অর্থাৎ জোর করে আল্লাহর বিধান পালন করানো যায় না। বরং নামাজ নামক আল্লাহর অস্ত্র দিয়ে যে কোন মানুষকে যে কোন খারাপ থেকে ফিরানো যাবে। ইহা আল্লাহর বাণী, আল্লাহর বিধান, আল্লাহর দায়েমী ফরজ। এই ফরজ নিজের মধ্যে কায়েম করতে হবে। এই নামাজ আদায় করলে বা এই নামাজ পড়লে সেই অস্ত্র হিসাবে নামাজ ক্রিয়াশীল হবে না। এই কথার মধ্যে কোন ঝুট নেই, এই কথার মধ্যে কোন কুটিলতা নেই এবং এই কথার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা বা দ্বিমত থাকতে পারে না। নামাজ কায়েম সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাকে বিরাশি জায়গায় ‘কায়েম কর’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন হিসেবে বিরাশি অপেক্ষা আরও অধিক জায়গায় নামাজের কায়েমিয়াত সম্পর্কে কঠিন নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ বলেছেন- وَأَقِيمُوا الصَّلوة (ওয়কিমুছ ছালাতা।” নামাজ কায়ে কর”।

 

কে বা কারা এই কায়েম শব্দটাকে আদায় বা পড়া শব্দে রুপান্তর করে নামাজের আসল বা মূল বিষয় ধামাচাপা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিয়েছে তা জানা যায় না।

 

ইহাও পরিতাপ যে, নামাজ মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে, এই একিন বা বিশ্বাস পর্যন্ত মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। কারণ পবিত্র কুরআন বলেছে, যেই মানুষ নামাজ কায়েম করবে সে সুদ-ঘুষ খাবে না, মিথ্যা বলবে না, অহংকার করবে না, গীবত করবে না, মিথ্যা লিখবে না, সত্য তথ্য না জেনে কারো সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করবে না। মিথ্যা লিখে অর্থ উপার্জন করবে না, মাপে কম দিবে না, ভেজাল দিবে না, অন্য ভাইকে ঠকাবে না, কারও হক নষ্ট করবে না, কারো ক্ষতি করবে না, চুরি করবে না, কাউকে ঘৃণা করবে না, জুলুম করবে না, বাহ্যিক সাজমূলক সুন্নতের বড়াই করে অহেতুক ফেৎনায় জড়িত জড়িত হবে না; সমাজে ফেৎনা সৃষ্টি হয় এমন কথাবার্তা বলবে না, কুরআন, হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গভীর মনোনিবেশ করবে, অর্থাৎ কারো মনে আঘাত লাগে বা আল্লাহর হুকুমের এতটুকু খেলাফ হয় এমন বাক্য নামাজ কায়েমকারীর মুখ থেকে বের হবে না।

 

নামাজ কায়েমকারী চিন্তা-ফিকির করে কাজ করবে, কম কথা বলবে, কম খাবে, কম ঘুমাবে, কম হাসবে, বেশি কাঁদবে, নিম্নগামী হয়ে পথ চলবে, আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকবে। আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল থাকতে পারবে না, কাউকে কুপরামর্শ দিবে না, হালাল হারাম বাছাই করার জন্য সর্বদা নিমগ্ন থেকে হালাল কামাই করতে যত ত্যাগ স্বীকার করা আবশ্যক তাতে তিল পরিমাণ ত্রুটি করবে না। সর্বোপরি নিশির শেষ ভাগে রহমতের সময় আল্লাহ তায়ালাকে অঝোর নয়নে ডাকবে। বিপদে-আপদে, অভাব-অভিযোগে নামাজ ও ছবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। ২৪ (চব্বিশ) ঘন্টা আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকবে ইত্যাদি।

 

এসব গুলাবলি যার মধ্যে পাওয়া যাবে না তার নামাজ হয়নি। তার নামাজ আদায় হয়েছে মাত্র, সে নামাজ পড়েছে মাত্র। ঐ নামাজে তার কোন ফল নেই। ইহা সম্পূর্ণ পন্ডশ্রম। বেহুদা পরিশ্রম। ফলশূন্য শুধু লোক দেখানো মসজিদে আনাগোনা। আর বাইরের সাজ, আসলে সাধু নয়। ‘সাধু ইহাও বাস্তব সন্নত নয়। ইহা হয়তো সামাজিক সুন্নত নয়তো সাধুর সাজ, সেজো না, সাধু হও।’ যিনি প্রকৃত সাধক তিনি হুট করে কোন রায় প্রদান করে না, কাউকে ধর্মের ব্যাপারে কটাক্ষ করে না। তিরস্কার করে না, অহংকার প্রমাণ করে এমন কোন কথা তার মুখ থেকে বের হয় না। কারণ তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে। নামাজ কায়েমকারীর অন্তরে এই ভীতির সঞ্চার হবে। সে অর্থ উপার্জনে হালালের চিন্তায় গুণে গুণে পা ফেলবে। ফলে তার ‘কথা’ কমে যাবে, মাথা নিম্নগামী হবে। মানুষের চোখে তিনি ভয়ের কারণ হবে এবং সম্মানের পাত্রে পরিণত হবে। তাঁর শত্রু থাকবে। যেমন রাসূলে পাক এর শত্রুরা তাকে যাদু পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর ক্ষতি করতে খুব একটা পারবে না, যদি ক্ষতি হয়ে যায়, তা তার পরীক্ষার জন্য। মোমেনকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন, তাও আল্লাহর বিধান। নামাজ কায়েমকারীর রিজিকের অভাব থাকবে, কিন্তু রিজিকের জন্য পেরেশানী হওয়ার কারণ থাকবে না। যেহেতু আল্লাহ যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, তিনিই নামাজ কায়েমকারী। মিথ্যা লিখে, মিথ্যা বলে ও দায়িত্ব আদায় না করে রিজিক উপার্জন করতে পাবে না। না খেয়ে কাঠ হয়ে যাবে, তার প্রতি ভর্ৎসনা, তিরস্কার আসবে, তারপরও এতটুকু বেহালাল বা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের চিন্তা করবে না।

 

নামাজ কায়েমকারী আত্মতৃপ্তিতে জীবন কাটাবেন। নামাজ কায়েমকারী অসুখী হতে পারে না। নামাজ কায়েমকারী অসুখী হতে তার কোন দলিল নেই। কিন্তু নামাজ কায়েমের পরিবর্তে যারা লোক দেখানো নামাজ পড়ে, অভ্যাসগত মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করে, দুনিয়ার চিন্তায় নিমগ্ন থেকে শুধুমাত্র মসজিদে আনা-গোনা করে, হাতেগোনা কয়েকটা টাক দেয়ার মত সেজদা করে, স্ব-স্ব অভ্যাসগতভাবে প্রতিনিয়ত মিথ্যা, হিংসা, গীবত, তিরস্কার ইত্যাদি গর্হিত কর্মে নিমগ্ন হয়, তাদের ঐ নামাজে তাদেরকে ধ্বংস করবে। কেননা নামাজ নিয়ে তামাশা করা আল্লাহ সহ্য করে না, তাই নামাজীদের জন্য আল্লাহর সাবধান বাণী- ب‎

 

‎‫و تاب در مورت فويل للمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ – (الماعون – ٤) উচ্চারণ: ফাওয়াই লুল্লিল মুছাল্লিন আল্লাজিনা হুম আন ছালাতিহিম সাহুন। “অতএব ধ্বংস ঐ নামাজীর জন্য যারা তাদের নামাজে নিজেদেরকে উদাসীন রাখে।” (আল’মাউন-৪)‬‎

 

বেনামাজী সম্পর্কে আল্লাহ যেভাবে কঠিন জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন অনুরূপ নামাজীদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো কঠিন সতর্কতার সাথে বলেছেন- ‘যারা উদাস মনে নামাজ আদায় করে বা পড়ে তাদের জন্য ইহকাল-পরকালে ধ্বংস অবধারিত।’ নামাজ পড়া ভাল, আদায় করা উত্তম এভাবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ভাল আর উত্তম বাস্তব নয়। পবিত্র কুরআনে বলেছেন: নামাজ কায়েম কর’। অতএব নামাজ পড়া ও আদায় করা দ্বারা নামাজকে খুব সহজ এবাদত ধরে নেয়া হয়ে থাকে। যদি তাই হত, তা হলে নামাজীদের জন্য ‘ওয়ায়েল’ বা ধ্বংস আল্লাহ একথা বলার কারণ কি? মূলত যেই নামাজে মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে, সেই নামায এত সহজ আমল নহে যে, আদায় করলে বা নামাজ পড়লেই সেই ফল পাওয়া যাবে। এই শব্দের দ্বারা নামাজকে হালকা আমল ধারণা করে একটা কথা বলে পরিত্রাণ পাওয়া যায়- “নামাজী জান্নাতে যাবে আর বেনামাজী জাহান্নামে যাবে।” আসলে কি পরিত্রাণ পাওয়া গেল? অবশ্যই না। বরং বাস্তব সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে বরং বাহ্যিক মুষ্টিমেয় সুন্নতের আংশিক পালন করে যারা অহংকারের দাম্ভিকতায় আসল নষ্ট করে, তাদের মত জাকেরগণ নয়। তার বাস্তবতা ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে উপলব্ধি হতে শুরু করেছে। সাইন বোর্ডধারী সুন্নত পালনকারীরা কি করে, তা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। সেই সকল বাস্তবতা ব্যক্ত করা হলে, তা অনেকের জন্য আতে ঘাঁ লাগবে এবং বিপরীত অর্থ করে আবার সমাজের ভিতরে ফেৎনার সৃষ্টি করা হবে। পাঠক ভাইয়েরা বুঝে নিয়ে নামাজ কায়েমের জন্য খাজাবাবার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ মোতাবেক হৃদয়ংগম মূলক নামাজ কায়েম করতে সচেষ্ট হবেন।

Sufibad 24

ব্লগটি শেয়ার করুন

Discover more from Sufibad.Com - সূফীবাদ.কম

Subscribe now to keep reading and get access to the full archive.

Continue reading

বিশ্ব জাকের মঞ্জিলের নামাজ ৫ম পর্ব

পাপ এবং পুণ্য যেই নেক আমলে নিহিত তার নাম ‘ছালাত’

আপডেট সময় : ০৯:৪২:৩৯ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

 

যেই আমল করলে পুণ্য, না করলে পাপ এ রকম এবাদত অসংখ্য। যেমন রোজা, হজ্জ, ওয়াজেব ও সুন্নতে মোয়াক্কাদা মূলক এবাদত সমূহ ইত্যদি। করলে পুণ্য না করলে পাপ নেই, যেমন সুন্নতে যায়েদা, নফল, মোস্তাহাব ইত্যাদি। কিন্তু উল্লেখযোগ্য একটি দায়েমী ইবাদত যা করলে পুণ্য, না করলে পাপ। শুধু তাই নয়, বরং যথাযথ নিয়মে সেই আমলটি করতে ব্যর্থ হলে তাতে পুণ্য তো হবেই না, আরো কঠিন পাপ হবে। যেমন ছালাত নামক ইবাদত। ছালাত দায়েমী ফরজ। ছালাত অর্থাৎ নামাজ কায়েম করতে হবে। হাদীসে এসেছে- ছালাত দ্বীনের স্তম্ভ। এই নামাজ কায়েম করতে হবে, ‘পড়া’ নয়। পবিত্র কুরআনে নামাজ কায়েম করতে হবে এই নির্দেশ এসেছে। ‘আদায় করা’ বা ‘নামাজ পড়া’ ইহা কুরআনের শব্দ নয়। বরং প্রচলিত অর্থের ব্যবহৃতরূপ। উপরন্তু এই প্রচলিত অর্থ মোতাবেকই নামাজ আদায় বা নামাজ পড়া হচ্ছে, পবিত্র কুরআনের নির্দেশ অনুযায়ী ‘কায়েম’ করা হচ্ছে না এবং কায়েম করার কাইফিতয়াত কি, তার বাস্তব প্রশিক্ষণও নেই। অথচ নামাজ দায়েমী ফরজ। এই দায়েমী ফরজকে সময়ের উপর ভিত্তি করে ‘আদায়’ বা ‘পড়া’ দ্বারা ‘দ্বায়েমী’ ও ‘কায়েম’ যেন ভুলিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে ‘হিতে বিপরীত’ ঘটনা ঘটানো হচ্ছে বা বিপরীত ঘটতেছে বা ঘটে চলেছে। পরিণামে কতিপয় (যার যেমন ইচ্ছা) সুন্নত দায়েমী হয়েছে। দায়েমী ফরজ যেন আদায় ও পড়া পর্যন্ত সীমাবদ্ধ রয়ে যাচ্ছে।

 

পক্ষান্তরে পরিতাপের সাথে অন্তর নিংড়িয়ে আক্ষেপ আসে- হায়রে সমাজ! হায়রে ঘুনে ধরা আলেম সমাজ! হায়রে ফতুয়াবাজের দল! ইসলাম কি বাস্ত বতার বিপরীত? পবিত্র কুরআনের বাস্তবতা ভুলে বা ভুলিয়ে দিয়ে প্রচলিত অর্থে দায়েমী ফরজকে ফল শূণ্য ইবাদতে পরিণত করা হয়েছে।

 

মূলত নামাজ যেমন কায়েম করতে হবে তেমনি কায়েমের মাধ্যমে দায়েমে পরিণত হয়ে এই নামাজ নামাজীকে পাপের পথ থেকে ফিরাবে। মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখার অস্ত্র নামাজ। নফসে আম্মারা দুনিয়ামুখী। পার্থিব জগতের চাকচিক্য, আরাম-আয়েশ, ভোগ-বিলাস, আনন্দ উৎসব, বা সেক্সুয়াল বাধ্যগত উদগ্রীবতার নেশা। অর্থাৎ পার্থিব যে কোন মোহ- মুগ্ধতা মানব মন থেকে ধীরে ধীরে মিটিয়ে দেযার বা খোদায়ী বিধান মোতাবেক জাগতিক সুখভিলাস ভোগ করার মনস্তাত্মিকতা বা মন তৈরি করার আল্লাহর অস্ত্র ‘নামাজ’। ইহা আল্লাহর ঘোষণা। যার উপরে কোন ফতুয়া বা যুক্তি বা দলিল চলে না। আল্লাহ বলেছেন-

 

‎‫إِنَّ الصَّلَوَةَ تَنْهَى عَنِ الْفَحْشَاءِ وَالْمُنْكَرِ (عَنْكَبُوت – (১৫)‬‎

 

উচ্চারণ: ইন্নাচ্ছালাতা তানহা আনিল ফাহশায়ে অল মুনকার। “নিশ্চয়ই নামায মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে।”

 

বর্ণিত আয়াতের স্পষ্ট ঘোষণা নামাজী খারাপ কাজ করতে পারে না। বস্তুত মানুষকে পাপের পথ থেকে তাকিদ করে, প্রসার দিয়ে, জোর করে শারীরিক নির্যাতন দিয়ে ফিরানো যাবে না। এখানেও আল্লাহও নির্দেশ لَا إِكْرَاهَ فِي الدِّينِ )লাইকরাহা ফিদদ্বীন)। “ধর্মের মধ্যে কোন জোর জরদস্তি নেই” (সূরায় বাকারাহ-২৫৬) অর্থাৎ জোর করে আল্লাহর বিধান পালন করানো যায় না। বরং নামাজ নামক আল্লাহর অস্ত্র দিয়ে যে কোন মানুষকে যে কোন খারাপ থেকে ফিরানো যাবে। ইহা আল্লাহর বাণী, আল্লাহর বিধান, আল্লাহর দায়েমী ফরজ। এই ফরজ নিজের মধ্যে কায়েম করতে হবে। এই নামাজ আদায় করলে বা এই নামাজ পড়লে সেই অস্ত্র হিসাবে নামাজ ক্রিয়াশীল হবে না। এই কথার মধ্যে কোন ঝুট নেই, এই কথার মধ্যে কোন কুটিলতা নেই এবং এই কথার মধ্যে কোন কৃত্রিমতা বা দ্বিমত থাকতে পারে না। নামাজ কায়েম সম্পর্কে পবিত্র কালামে পাকে বিরাশি জায়গায় ‘কায়েম কর’ শব্দটা ব্যবহৃত হয়েছে। কোন কোন হিসেবে বিরাশি অপেক্ষা আরও অধিক জায়গায় নামাজের কায়েমিয়াত সম্পর্কে কঠিন নির্দেশ এসেছে। আল্লাহ বলেছেন- وَأَقِيمُوا الصَّلوة (ওয়কিমুছ ছালাতা।” নামাজ কায়ে কর”।

 

কে বা কারা এই কায়েম শব্দটাকে আদায় বা পড়া শব্দে রুপান্তর করে নামাজের আসল বা মূল বিষয় ধামাচাপা দিয়ে মানুষকে বিভ্রান্তির পথে ঠেলে দিয়েছে তা জানা যায় না।

 

ইহাও পরিতাপ যে, নামাজ মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে ফিরিয়ে রাখে, এই একিন বা বিশ্বাস পর্যন্ত মানুষ ভুলে যেতে বসেছে। কারণ পবিত্র কুরআন বলেছে, যেই মানুষ নামাজ কায়েম করবে সে সুদ-ঘুষ খাবে না, মিথ্যা বলবে না, অহংকার করবে না, গীবত করবে না, মিথ্যা লিখবে না, সত্য তথ্য না জেনে কারো সম্বন্ধে কোন মন্তব্য করবে না। মিথ্যা লিখে অর্থ উপার্জন করবে না, মাপে কম দিবে না, ভেজাল দিবে না, অন্য ভাইকে ঠকাবে না, কারও হক নষ্ট করবে না, কারো ক্ষতি করবে না, চুরি করবে না, কাউকে ঘৃণা করবে না, জুলুম করবে না, বাহ্যিক সাজমূলক সুন্নতের বড়াই করে অহেতুক ফেৎনায় জড়িত জড়িত হবে না; সমাজে ফেৎনা সৃষ্টি হয় এমন কথাবার্তা বলবে না, কুরআন, হাদীসের ব্যাখ্যা দিতে গভীর মনোনিবেশ করবে, অর্থাৎ কারো মনে আঘাত লাগে বা আল্লাহর হুকুমের এতটুকু খেলাফ হয় এমন বাক্য নামাজ কায়েমকারীর মুখ থেকে বের হবে না।

 

নামাজ কায়েমকারী চিন্তা-ফিকির করে কাজ করবে, কম কথা বলবে, কম খাবে, কম ঘুমাবে, কম হাসবে, বেশি কাঁদবে, নিম্নগামী হয়ে পথ চলবে, আল্লাহর জিকিরে মশগুল থাকবে। আল্লাহর জিকির থেকে গাফেল থাকতে পারবে না, কাউকে কুপরামর্শ দিবে না, হালাল হারাম বাছাই করার জন্য সর্বদা নিমগ্ন থেকে হালাল কামাই করতে যত ত্যাগ স্বীকার করা আবশ্যক তাতে তিল পরিমাণ ত্রুটি করবে না। সর্বোপরি নিশির শেষ ভাগে রহমতের সময় আল্লাহ তায়ালাকে অঝোর নয়নে ডাকবে। বিপদে-আপদে, অভাব-অভিযোগে নামাজ ও ছবরের মাধ্যমে আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা করবে। ২৪ (চব্বিশ) ঘন্টা আল্লাহর জিকিরে নিমগ্ন থাকবে ইত্যাদি।

 

এসব গুলাবলি যার মধ্যে পাওয়া যাবে না তার নামাজ হয়নি। তার নামাজ আদায় হয়েছে মাত্র, সে নামাজ পড়েছে মাত্র। ঐ নামাজে তার কোন ফল নেই। ইহা সম্পূর্ণ পন্ডশ্রম। বেহুদা পরিশ্রম। ফলশূন্য শুধু লোক দেখানো মসজিদে আনাগোনা। আর বাইরের সাজ, আসলে সাধু নয়। ‘সাধু ইহাও বাস্তব সন্নত নয়। ইহা হয়তো সামাজিক সুন্নত নয়তো সাধুর সাজ, সেজো না, সাধু হও।’ যিনি প্রকৃত সাধক তিনি হুট করে কোন রায় প্রদান করে না, কাউকে ধর্মের ব্যাপারে কটাক্ষ করে না। তিরস্কার করে না, অহংকার প্রমাণ করে এমন কোন কথা তার মুখ থেকে বের হয় না। কারণ তার অন্তর আল্লাহর ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত থাকবে। নামাজ কায়েমকারীর অন্তরে এই ভীতির সঞ্চার হবে। সে অর্থ উপার্জনে হালালের চিন্তায় গুণে গুণে পা ফেলবে। ফলে তার ‘কথা’ কমে যাবে, মাথা নিম্নগামী হবে। মানুষের চোখে তিনি ভয়ের কারণ হবে এবং সম্মানের পাত্রে পরিণত হবে। তাঁর শত্রু থাকবে। যেমন রাসূলে পাক এর শত্রুরা তাকে যাদু পর্যন্ত করেছিল। কিন্তু তাঁর ক্ষতি করতে খুব একটা পারবে না, যদি ক্ষতি হয়ে যায়, তা তার পরীক্ষার জন্য। মোমেনকে আল্লাহ পরীক্ষা করবেন, তাও আল্লাহর বিধান। নামাজ কায়েমকারীর রিজিকের অভাব থাকবে, কিন্তু রিজিকের জন্য পেরেশানী হওয়ার কারণ থাকবে না। যেহেতু আল্লাহ যার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যান, তিনিই নামাজ কায়েমকারী। মিথ্যা লিখে, মিথ্যা বলে ও দায়িত্ব আদায় না করে রিজিক উপার্জন করতে পাবে না। না খেয়ে কাঠ হয়ে যাবে, তার প্রতি ভর্ৎসনা, তিরস্কার আসবে, তারপরও এতটুকু বেহালাল বা অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের চিন্তা করবে না।

 

নামাজ কায়েমকারী আত্মতৃপ্তিতে জীবন কাটাবেন। নামাজ কায়েমকারী অসুখী হতে পারে না। নামাজ কায়েমকারী অসুখী হতে তার কোন দলিল নেই। কিন্তু নামাজ কায়েমের পরিবর্তে যারা লোক দেখানো নামাজ পড়ে, অভ্যাসগত মসজিদে জামাতে নামাজ আদায় করে, দুনিয়ার চিন্তায় নিমগ্ন থেকে শুধুমাত্র মসজিদে আনা-গোনা করে, হাতেগোনা কয়েকটা টাক দেয়ার মত সেজদা করে, স্ব-স্ব অভ্যাসগতভাবে প্রতিনিয়ত মিথ্যা, হিংসা, গীবত, তিরস্কার ইত্যাদি গর্হিত কর্মে নিমগ্ন হয়, তাদের ঐ নামাজে তাদেরকে ধ্বংস করবে। কেননা নামাজ নিয়ে তামাশা করা আল্লাহ সহ্য করে না, তাই নামাজীদের জন্য আল্লাহর সাবধান বাণী- ب‎

 

‎‫و تاب در مورت فويل للمُصَلِّينَ الَّذِينَ هُمْ عَنْ صَلَاتِهِمْ سَاهُونَ – (الماعون – ٤) উচ্চারণ: ফাওয়াই লুল্লিল মুছাল্লিন আল্লাজিনা হুম আন ছালাতিহিম সাহুন। “অতএব ধ্বংস ঐ নামাজীর জন্য যারা তাদের নামাজে নিজেদেরকে উদাসীন রাখে।” (আল’মাউন-৪)‬‎

 

বেনামাজী সম্পর্কে আল্লাহ যেভাবে কঠিন জাহান্নামের ভয় দেখিয়েছেন অনুরূপ নামাজীদের সম্পর্কে আল্লাহ আরো কঠিন সতর্কতার সাথে বলেছেন- ‘যারা উদাস মনে নামাজ আদায় করে বা পড়ে তাদের জন্য ইহকাল-পরকালে ধ্বংস অবধারিত।’ নামাজ পড়া ভাল, আদায় করা উত্তম এভাবে বলা হয়ে থাকে। কিন্তু ভাল আর উত্তম বাস্তব নয়। পবিত্র কুরআনে বলেছেন: নামাজ কায়েম কর’। অতএব নামাজ পড়া ও আদায় করা দ্বারা নামাজকে খুব সহজ এবাদত ধরে নেয়া হয়ে থাকে। যদি তাই হত, তা হলে নামাজীদের জন্য ‘ওয়ায়েল’ বা ধ্বংস আল্লাহ একথা বলার কারণ কি? মূলত যেই নামাজে মানুষকে খারাপ ও অশ্লীল কাজ থেকে বিরত রাখে, সেই নামায এত সহজ আমল নহে যে, আদায় করলে বা নামাজ পড়লেই সেই ফল পাওয়া যাবে। এই শব্দের দ্বারা নামাজকে হালকা আমল ধারণা করে একটা কথা বলে পরিত্রাণ পাওয়া যায়- “নামাজী জান্নাতে যাবে আর বেনামাজী জাহান্নামে যাবে।” আসলে কি পরিত্রাণ পাওয়া গেল? অবশ্যই না। বরং বাস্তব সত্যকে ধামাচাপা দিয়ে বরং বাহ্যিক মুষ্টিমেয় সুন্নতের আংশিক পালন করে যারা অহংকারের দাম্ভিকতায় আসল নষ্ট করে, তাদের মত জাকেরগণ নয়। তার বাস্তবতা ইতিমধ্যেই মানুষের মধ্যে উপলব্ধি হতে শুরু করেছে। সাইন বোর্ডধারী সুন্নত পালনকারীরা কি করে, তা আজ দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট। সেই সকল বাস্তবতা ব্যক্ত করা হলে, তা অনেকের জন্য আতে ঘাঁ লাগবে এবং বিপরীত অর্থ করে আবার সমাজের ভিতরে ফেৎনার সৃষ্টি করা হবে। পাঠক ভাইয়েরা বুঝে নিয়ে নামাজ কায়েমের জন্য খাজাবাবার শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ মোতাবেক হৃদয়ংগম মূলক নামাজ কায়েম করতে সচেষ্ট হবেন।