ড. খাজা সায়েম আমীর ফয়সাল মুজাদ্দেদী ছাহেবের নিজ লেখনীতে
রুহের পুনর্জাগরণ: হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) ও হজরত মাওলানা রুমি (রহঃ) এর পরম বন্ধন
- আপডেট সময় : ০৯:৪৬:০০ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৭ অক্টোবর ২০২৪
- / ২৪৬১ বার পড়া হয়েছে
রুহের পুনর্জাগরণ: হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) ও হজরত মাওলানা রুমি (রহঃ) এর পরম বন্ধন
তব্রিজের হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ), রহস্যময় এক পথিক, যার পরিচয় এবং উদ্দেশ্য যেন মরুভূমির নিরব বাতাসের মতো, ধরা ছোঁয়ার অতীত। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক জ্ঞানে উজ্জ্বল, কিন্তু কোনো প্রচলিত শাস্ত্রের পথে বাঁধা ছিলেন না। তাঁর আত্মা এমন এক আলোর উৎস ছিল যা সাধারণ মানুষ বুঝতে বা উপলব্ধি করতে পারত না। শহর থেকে শহরে, নগর থেকে নগরে ঘুরে বেড়াতেন তিনি, খুঁজতেন এমন এক হৃদয় যা তাঁর গভীর আল্লাহ প্রেমের সাথে মিশে যেতে পারে।
কোনিয়ায় এসে তিনি খুঁজে পেলেন সেই হৃদয়—হজরত মাওলানা রুমি (রহ:), একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত এবং ধর্মতাত্ত্বিক। তিনি তখন একজন প্রখ্যাত জ্ঞানী মানুষ, কুরআনের গভীর বোঝাপড়া এবং ইসলামী আইন বিষয়ে অত্যন্ত পারদর্শী। তাঁর অনুসারীরা, মাওলানারা, তাঁকে ঘিরে বসতেন জ্ঞানার্জনের আশায়, কারণ হজরত মাওলানা রুমি (রহ:) কুরআনের প্রতিটি বাণীর ওপর অসামান্য দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। কিন্তু এত জ্ঞান থাকা সত্ত্বেও, হজরত মাওলানা রুমি (রহ:) তখনও জ্ঞানসীমার বাইরে সেই আধ্যাত্মিক আলোর স্বাদ পাননি, যা কুরআনের ঘনঘোর গভীরতায় লুকিয়ে ছিল।
হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) যখন হজরত মাওলানা রুমি (রহ:)-এর জীবনে প্রবেশ করেন, তিনি তাঁর সাথে নিয়ে আসেন সেই আধ্যাত্মিক আলোর শিখা যা রুমির জীবনকে চিরতরে রূপান্তরিত করে। তাঁদের প্রথম সাক্ষাতেই হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) হজরত মাওলানা রুমি (রহ:)-কে প্রশ্ন করেন, “তুমি কি সত্যিই কুরআনের আধ্যাত্মিক গভীরতা বুঝতে পেরেছো?” রুমি, যিনি কুরআনের প্রতিটি আয়াত গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছিলেন, এক মুহূর্তের জন্য থমকে গেলেন। তখনই তিনি উপলব্ধি করলেন, তাঁর জ্ঞান যেন এক গভীর সমুদ্রের পৃষ্ঠের মতো—সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ, কিন্তু তার গভীরে প্রবেশ করা তখনও বাকি ছিল।
শামসের সাথে হজরত মাওলানা রুমি (রহ:)-এর গভীর বন্ধুত্ব শুরু হলে তাঁকে নিয়ে অভিযোগ উঠল। রুমির অনুসারীরা বলতে লাগল, “এই পথিক যেন আমাদের প্রিয় শিক্ষকের মন কেড়ে নিয়েছে। কীভাবে একজন প্রখ্যাত জ্ঞানী মানুষ শাস্ত্র এবং প্রথা ছেড়ে এই ভবঘুরে পথিকের সাথে আধ্যাত্মিকতায় নিমগ্ন হতে পারে?” তাদের চোখে, শামসের সাথে রুমির সম্পর্ক যেন জ্ঞানের প্রতি একধরনের বিশ্বাসঘাতকতা ছিল।
কিন্তু শামস হজরত মাওলানা রুমি (রহ:)-এর মন চুরি করেননি—তিনি তাঁর মনকে মুক্ত করেছিলেন। শামস তাঁকে দেখিয়েছিলেন যে, কুরআনের গভীর উপলব্ধি শুধুমাত্র এর শব্দের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, বরং এর আধ্যাত্মিক অন্তর্দৃষ্টি হৃদয়ের গভীরে উপলব্ধি করতে হয়। “তুমি কুরআন মুখস্থ করেছো, কিন্তু এর আত্মার শ্বাস কি তুমি অনুভব করেছো?” শামস প্রশ্ন করতেন।
হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ)-এর পথনির্দেশনায় হজরত মাওলানা রুমি (রহ:) বুঝতে পারলেন, কুরআন কেবল একটি পঠিত গ্রন্থ নয়, এটি একটি জীবন্ত মহাসাগর, যেখানে আল্লাহর ভালোবাসার স্রোত প্রবাহিত হয়। সেই মাওলানারা, যারা কুরআনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা পোষণ করতেন, তারা এর আধ্যাত্মিক গভীরতাকে পুরোপুরি বুঝতে পারেননি। তারা আয়াত মুখস্থ করতেন, তার ব্যাখ্যা নিয়ে তর্ক করতেন এবং তার নিয়ম অনুসরণ করতেন, কিন্তু তারা এই আধ্যাত্মিক গভীরতার অনুভব করতে ব্যর্থ ছিলেন। শামস এই বুদ্ধিবৃত্তিক সীমাবদ্ধতা ভেঙে হজরত মাওলানা রুমি (রহ:)-এর হৃদয়কে আল্লাহর প্রেমের সত্যের দিকে উন্মুক্ত করলেন—কুরআন কেবল পড়ার জন্য নয়, বরং তার গভীরতম প্রেম ও আল্লাহর সাথে সংযোগ অনুভবের জন্য।
হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) তাঁকে শিখিয়েছিলেন যে কুরআনের আধ্যাত্মিক সারাংশ, অর্থাৎ ভালোবাসা, যা সৃষ্টির সমস্ত কিছুকে আল্লাহর সাথে যুক্ত করে, মস্তিষ্ক দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়। এটি হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়, প্রতিটি শ্বাসে, প্রতিটি হৃদস্পন্দনে। সেই মাওলানারা, যারা বাহ্যিক পবিত্রতা এবং জ্ঞান নিয়ে গর্ব করতেন, এই সত্যটি পুরোপুরি মিস করেছিলেন। শামসের প্রস্থানে রুমির ভিতরে সেই আধ্যাত্মিক আলো জ্বলে উঠেছিল। তিনি তখন লিখেছিলেন:
“আমি কুরআন মুখস্থ করেছি, কিন্তু শামসই আমার হৃদয়কে এর গভীরতায় পৌঁছতে সাহায্য করেছেন। আমি শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছি, কিন্তু শামসই আমাকে আল্লাহর প্রেমকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছেন।”
হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) এর সাথে আধ্যাত্মিক বন্ধনে হজরত মাওলানা রুমি (রহ:) একজন প্রখ্যাত পণ্ডিত থেকে পরিণত হন এক হৃদয়ের কবিতে, একজন আল্লাহর প্রেমিক হয়ে।
আমার একটি ক্ষুদ্র অভিমত, হজরত শামস তব্রিজ (রহঃ) এবং হজরত মাওলানা জালালুদ্দিন রুমি (রহঃ) এর মধ্যে যে অনন্ত বন্ধন, আধ্যাত্মিক শিক্ষা, কুরআনের গভীর উপলব্ধি, এবং আল্লাহর প্রেমের যে অসাধারণ প্রতিফলন ছিল, তেমনই সাদৃশ্য আমি লক্ষ্য করেছি হজরত খাজা ইউনুস আলী (রহঃ) এবং জাকের পার্টির মহান প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা মুহাম্মদ হাশমতুল্লাহ (রহঃ) এর জীবন, শিক্ষা ও আল্লাহর পথে নিরবিচ্ছিন্ন সাধনার মধ্যে। কুরআনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ইসলামী শিক্ষার আলোকে তাদের জীবনে আল্লাহর প্রেম এবং আধ্যাত্মিকতার যে মিল, তা আমার ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছে।