ছোহবতে খাজাবাবা ফরিদপুরী (রাঃ) ছাহেব বই থেকে নেওয়া
সে যে রাজার রাজা মহারাজা, দয়াল বাবা খোদে খাজা

- আপডেট সময় : ০৫:১৬:৩১ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ অক্টোবর ২০২৫
- / ২৩৯২ বার পড়া হয়েছে
খাজাবাবা রাজার রাজা
আশেকানরা গজলের সুরে গায়-
“সে যে রাজার রাজা মহারাজা, দয়াল বাবা খোদে খাজা”
আবার আরো গায়-
“খাজা তুমি মহারাজা, আমরা তোমার অবুঝ প্রজা, নেওনা আপন করিয়া”
বিশ্ব পরিক্রমার তামাম ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে যে, তাবৎ জগতবরেণ্য ওলী আল্লাহ সকল দুনিয়ার বুকে আবির্ভূত হন মহান আল্লাহর কুদরতী শক্তি নিয়ে ‘মুকুট বিহীন সম্রাট’ হয়ে। আল্লাহর ওলীগণ এই জগত সংসারে রাজা হতে নন বরং রাজা বানাতে এবং শাসন করতে নয় বরং শাসন করাতে আসেন। আমাদের দয়াল পীর বিশ্ব মানবতার ওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:)ও তেমনি রাজা বানাতে, আল্লাহর জমিনে আল্লাহর রাজত্ব কায়েমের শক্ত প্লাটফরম সৃষ্টি করতে আবির্ভুত হন। কেননা খাজাবাবা ফরিদপুরী পীর কেবলাজান হুজুরের জীবন ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তারই উজ্জলতর দৃষ্টান্ত খুজে পাওয়া যায়।
আটরশির অজপাড়া গায়ে সুদীর্ঘ অর্ধ শতাব্দী ধরে তিনি বিশ্ব জাকের মঞ্জিল নামের আধ্যাত্মিক প্লাটফরম তৈরী করেছেন, যেখানে বাংলাদেশসহ তামাম বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রী, আমলা, সেনানায়ক, রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবি, শ্রমজীবি, কৃষিজীবি, ছাত্র-শিক্ষক, ধনী-নির্ধন, মজুর, বিধর্মী ভক্তবৃন্দ সহ সকল ধর্ম-বর্ণ-গোত্রের মানুষ এক কাতারে খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:) কেবলাজান হুজুরের নিকট গিয়েছেন, তাঁর বয়াত গ্রহণ করেছেন, তাঁর ধর্মীয় আধ্যাত্মিক তথা জাগতিক ও পারলৌকিক সকল প্রকার পরামর্শ গ্রহণ করে উপকৃত এবং ধন্য হয়েছেন। তাঁর সাথে ছিল খোদ আল্লাহ তায়ালার জাতের সম্পর্ক। স্বীয় কঠিন ব্রত এবং সাধনা বলে তিনি বান্দা থেকে আল্লাহ তায়ালার বন্ধুতে পরিণত হয়েছিলেন। তিনি এসেছিলেন আল্লাহর শান-মান প্রচার করার জন্য এবং আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দ্বীনের প্রচার এবং প্রসারের জন্য। তিনি ছিলেন জমিনে আল্লাহ তায়ালার খাস প্রতিনিধি।
আরো পড়ুন:পীর কী ও কেন? সুফিবাদে পীরের গুরুত্ব
পূর্ব যুগের ওলী আল্লাহগণের মধ্যে বিশেষ করে বড় পীর হযরত আব্দুল কাদের জিলানী (র:), গরীবে নেওয়াজ হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি আজমীরি (র:), ইমামে রব্বানী হযরত শায়খ আহমদ সিরহিন্দী মোজাদ্দেদ আল ফেসানী (র:), হযরত শাহজালাল (র:) প্রভৃতি বিশ্ববরেণ্য ওলীগণের জীবনী থেকে দেখা যাবে তাঁরা কেউই নিজেরা রাজা হননি, বরং মানব কল্যানে রাজা তৈরী করেছেন। কোন রাজা-বাদশাহর দরবারে তাঁরা ধর্ণা দেন নাই, বরং খোদ রাজা-বাদশাহরাই তাঁদের দরবারে ধর্ণা দিয়েছেন। তদ্রুপ আমার দয়াল পীর খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:) তাঁর সুদীর্ঘ জীবনে কোন দিন কোন রাজা বাদশাহ তথা কোন রাষ্ট্রপ্রধান বা মন্ত্রীর কাছে যান নাই, ধর্ণা দেন নাই বা কারো কাছে কিছু চান নাই। এমনকি কারো কোন দানও তিনি গ্রহণ করেন নাই। বরং বহু বরেণ্য রাজনীতিবিদ, মন্ত্রী-আমলা, সেনানায়কই তাঁর কাছে গিয়ে তাঁর উপদেশ শুনে ধন্য ও উপকৃত হয়েছেন যার অজস্র নজির দুনিয়ার বুকে বিদ্যমান আছে। আমি তার দু’একটি ঘটনা উদাহরণ হিসেবে এখানে তুলে ধরতে চাই।
ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মতিউর রহমান ভাই (মৃত্যুর পূর্বে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন কিনা আমার জানা নেই) একদিন খাজাবাবার নিকট তার নিজের কথা শেষে প্রয়াত প্রেসিডেন্ট লে: জেঃ জিয়াউর রহমানের সম্পর্কে বলেন, “হুজুর, সেদিন জেনারেল জিয়ার সাথে আমি নর্থ বেঙ্গল যাচ্ছিলাম। রাস্তায় উত্তর বঙ্গ থেকে আসা বিশাল গরুর কাফেলা দেখে তিনি প্রশ্ন করেন যে এত গরু নিয়ে শত শত লোকজন ‘আল্লাহু আকবর’ পতাকা হাতে কোথায় যাচ্ছে। আমি বললাম যে, স্যার এগুলি ফরিদপুরের আটরশির পীর সাহেবের দরবারে উরস শরীফের নজরানার গরুর কাফেলা নিয়ে জাকেরানরা বিশ্ব জাকের মঞ্জিল পাক দরবার শরীফ যাচ্ছে। তখন জেনারেল জিয়া বললেন, ও তুমিতো আটরশির পীর সাহেবের মুরীদ। এই বলেই তিনি গাড়ী থামাতে বললেন। গাড়ী রাস্তার পাশে দাড় করিয়ে রেখে তিনি যতক্ষণ পর্যন্ত গরুর কাফেলা আমাদের অতিক্রম করে না গেল ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি সেল্যুট দিয়ে দাড়িয়ে রইলেন”। ঘটনা শুনে খাজাবাবা বললেন, “বাবা, জিয়াউর রহমান সাহেব একজন সৎ এবং ভাল লোক। বাবা, আল্লাহর ওলীর দরবার তথা আল্লাহ ও রাসুলের দরবারের নজরানার কাফেলাকে সম্মান দেখিয়ে তিনি আদতে আল্লাহ ও রাসুল (সা:) কেই সম্মান দেখিয়েছেন। তিনিই সম্মানের যোগ্য। মহান আল্লাহ পাকও অবশ্যই তাকে সম্মানিত করবেন, সম্মানের আসনে বসাবেন। বাবা, দেশের বর্তমান সময়ে তার মত একজন সৎ, নির্ভীক নিষ্ঠাবান রাষ্ট্রনায়কের দরকার। বাবা, ওনাকে আমার দোয়া জানাবেন।
আমি দোয়া করি মহান আল্লাহ পাক তার মত ভাল লোককে রাজার সম্মানে ভূষিত করুন”। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই জেনারেল জিয়াউর রহমান সাহেব দেশের রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন।
রাষ্ট্রপতি হবার পর একবার জিয়াউর রহমান সাহেব বিশ্ব জাকের মঞ্জিলে গিয়ে খাজাবাবার সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং অনেক টাকা নজরানা হিসেবে খাজাবাবার সামনে তুলে ধরেন। খাজাবাবা জিয়াউর রহমান সাহেবের হাতের টাকা থেকে মাত্র একটি টাকা নজরানা হিসেবে গ্রহণ করে অবশিষ্ট টাকা ফিরিয়ে দেন এবং বিদায় কালে খাজাবাবা জিয়াউর রহমান সাহেবকে বলেছিলেন, “বাবা, আমাকে না জানিয়ে যেন ঢাকার বাইরে যাবেননা” এবং তার হাতে একটি সুগন্ধি আতরের শিশি তুলে দিয়ে বলেছিলেন, “বাবা, এটি আপনার সাথে রাখবেন। আমি দোয়া করি আপনি সুগন্ধ ধারণ করেন এবং এই সুগন্ধ নিয়েই যেন আল্লাহ পাক আপনাকে দুনিয়া থেকে তুলে নেন”। দুনিয়াবাসী অবশ্যই প্রত্যক্ষ করেছেন কি সুগন্ধ নিয়ে জিয়াউর রহমান সাহেব দুনিয়াতে ছিলেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছেন।
আমাদের মহান মুর্শিদ খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:) কেবলাজান হুজুরের দোয়ায় আল্লাহর রহমতে দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছেন তার আর একটি উদাহরণ হচ্ছে লে: জে: হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ সাহেব। খাজাবাবা যেদিন এরশাদকে মুরীদ করেন, সেদিন খাজাবাবা প্রথমে তাকে তওবা পড়িয়ে কাল্ব বাতিয়ে মুরীদ করেন। মুরীদ করার পর খাজাবাবা মাওলানা আবু লাইছ আনসারী সাহেবকে ডেকে এরশাদ সাহেবকে ওছিলা ধরে ফয়েজ বাতিয়ে দিতে বলেন। যথা নিয়মে ফয়েজ বাতানো শেষে মাওলানা আনসারী সাহেব এরশাদ সাহেবকে নিয়ে খাজাবাবার সামনে হাজির হন। তখন হুজুর কেবলাজান মসজিদে আছরের নামাজে যাওয়ার জন্য রওনা হচ্ছিলেন। খাজাবাবা এরশাদকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “বাবা, নামাজে যান, আমিও আসছি। নামাজের পর বাবা আপনার কথা শুনব এবং বিদায় দিব”। এরশাদ সাহেব মসজিদে যাবার জন্য দরজা অতিক্রম করতেই খাজাবাবা মুচকি হেসে মাওলানা আনসারীকে ইশারায় কাছে ডেকে এরশাদ সাহেবের প্রতি অংগুলি মোবারক নির্দেশ করে বললেন, “বাবা, এই লোকটাকে চেনেন? উনি দেশের পরবর্তী বাদশাহ। বাবা, আপনি ভাগ্যবান যে দেশের পরবর্তী বাদশাহকে আপনি ওছিলা ধরে ফয়েজ বাতালেন”। সেই সময় এরশাদ সাহেব কর্ণেল অথবা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল পদমর্যাদায় চাকুরীরত ছিলেন। আমরা বুঝতে পারলাম যে যেহেতু খাজাবাবা বলেছেন বিধায় যে কোন প্রক্রিয়াতেই হোক না কেন এই এরশাদ একদিন দেশের রাষ্ট্রপতি হবেন। আর হয়েছেও তাই।
আরো পড়ুন:ইসলামী শরিয়াতের দৃষ্টিতে কদমবুছি
আর একদিনের ঘটনা। খাজাবাবা বিকেল বেলা প্রতিদিনের মত দরবার শরীফের বিভিন্ন কর্মকান্ড স্বচক্ষে তদারকি করতে বেরিয়েছেন। আমরা অনেক জাকের ভাইয়েরা হুজুর পাকের পিছনে পিছনে হাটছিলাম। মাঝে মধ্যেই হুজুর দাড়িয়ে পিছনে থাকা খাদেমকে প্রয়োজনীয় কথাবার্তা জিজ্ঞাসা করেন। আর আমরা হঠাৎ থামার কারণে একে অন্যের উপর হুমরি খেয়ে পড়ছিলাম। এক পর্যায়ে চৌদ্দরশি বাজার সংলগ্ন কালিখোলা তেমাথা থেকে দরবার শরীফের সাথে তৎকালীন সংযোগ স্থাপনকারী যে নতুন রাস্তাটি তৈরী করা হয়েছিল সেদিকে নজর পড়তেই খাজাবাবা বললেন, “বাবা, নতুন রাস্তায় গাড়ীর চাকার দাগ দেখা যায়। কার গাড়ী গেল?”। নতুন রাস্তাটিতে মাটি ফেলা শেষে ইট বিছানোর আগে রোলার দিয়ে মাটি কাগজের মত সমান করে রাখা হয়েছিল। জেনারেল এরশাদ সাহেব দরবার শরীফে এসেছিলেন। খাজাবাবার সাথে সাক্ষাৎ শেষে ঐ নতুন রাস্তা দিয়ে গাড়ী চালিয়ে যাওয়ায় রাস্তাটিতে গাড়ীর চাকার দাগ পড়ে গিয়েছিল। সেটা দেখেই খাজাবাবা আচমকা উক্ত প্রশ্ন করেন। জবাবে সিরাজ ভাইজান বলেন, “হুজুর, এরশাদ সাহেব যাবার সময় নতুন রাস্তা দিয়ে গেছেনতো তাই ওনার গাড়ীর চাকার দাগ”। কেবলাজান হুজুর তখন মুচকি হেসে বললেন, “ভালই হলো বাবা, নতুন রাস্তা দেশের রাজাই উদ্বোধন করে গেলেন”। আমরা তখন বুঝতে পারলাম এরশাদ সাহেব দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হবেন। এমনি ভাবে মহাওলী খাজাবাবা ফরিদপুরী (কু:) সাহেব মানুষকে রাজত্ব দান করেছেন, কিন্তু তিনি নিজে রাজা হননি। কারণ তিনি ছিলেন রাজার রাজা, মুকুটহীন মহারাজা।
এখানে সবিনয়ে উল্লেখ করা যাচ্ছে যে, প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং সাবেক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এইচ এম এরশাদ তারা অবশ্যই বরেণ্য ব্যাক্তি। তাদের ব্যাক্তিগত, পারিবারিক বা রাজনৈতিক জীবনের সফলতা বা ব্যর্থতা ইত্যাদি কোন কিছুই আমার আলোচ্য বিষয় নয়। আমি এই দুইজন দেশের রাষ্ট্রপতি হবার আগে খাজাবাবার সান্নিধ্যে আমার উপস্থিতিতে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার অংশ বিশেষ উল্লেখ করেছি মাত্র।