তাযকেরাতুল আওলিয়া বা আওলিয়া কাহিনী
হযরত শেখ ফরিদ উদ্দিন আত্তার (রহ:) এর সংক্ষিপ্ত জীবনী
- আপডেট সময় : ০৪:০০:১৫ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৪ অগাস্ট ২০২৪
- / ২৪৫৯ বার পড়া হয়েছে
গ্রন্থ রচনার ক্ষেত্রে অভিনবত্ব: শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর রচনাবলীর মধ্যে “মানতিকৃত তায়ির” নামক গ্রন্থখানার বিষয়বস্তু এবং তাঁর প্রকাশ ভঙ্গি এক নব ধারায়। তিনি সর্বাগ্রে আল্লাহ ও হুজুর (সাঃ)-এর প্রশংসা এবং গুণ-কীর্তনের পরে খোলাফায়ে রাশেদীনের সুযোগ্য নেতৃত্বের সুখ্যাতি বর্ণনা করার পর মূল বক্তব্য শুরু করেন নিম্নরূপে।
তাঁর কাহিনীর নায়কদিগকে কল্পনা করা হয়েছে পাখি হিসেবে যেমন-হুদহুদ, তোতা, মোরগ, কবুতর, শানা, বুলবুলি, বাজ প্রভৃতি। কাহিনী অবতারণা করেছেন তিনি এভাবে। উল্লেখিত পাখিগুলো একদিন এক সভায় মিলিত হয়ে তাদের মধ্য হতে কোন একজনকে বাদশাহ নির্বাচন করার সংকল্প করল। হুদহুদ পাখি এ পদের জন্য ছী মোরগের নাম প্রস্তাব করল। কিন্তু এতে অন্যান্য পাখিরা আপত্তি তুলে। হুদহুদ পাখি তাদের সকলের আপত্তির কারণগুলো ধীরে সুস্থ্যে শ্রবণ করে সকলের আপত্তির কারণই খণ্ডণ করে। শেষ মেষ সকল পাখিই এক বাক্যে হুদহুদ পাখির প্রস্তাব সমর্থন করল এবং দ্বী মোরগকেই নিজেদের বাদশাহ অবিধায় স্বীকার করেনিল। অতঃপর তাঁর কার্য ধারা সম্পর্কিত বিষয়াবলী, যাহা সাধারণতঃ তরীকত পন্থীদের মানষপটে জাগরুক হয়ে থাকে, তাহা গ্রন্থকার প্রশ্নোত্তরের রীতিতে অত্র গ্রন্থে পরিবেশন করেছেন। গ্রন্থখানার নাম “মানতিকুত তায়ির” তিনি পাক কুরআনের সূরা নামল হতে গ্রহণ করেছেন।
হুদহুদ পাখি বুদ্ধির বিচারে পাখিকুলের ভিতর সেরা বিবেচনায় হযরত সোলায়মান (আঃ) হুদহুদ পাখিকে অত্যন্ত আদর করতেন এবং ভালবাসতেন। অপরদিকে শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ) ও তাঁর কাহিনীর পাখির নায়কদের হুদহুদরূপে বিচক্ষণ সালেকের মুখ দ্বারা প্রকাশ করেছেন।
হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ) শুধুমাত্র কাব্য সাহিত্যেই যশস্বী ছিলেন, তা নয়। বরং সেই সময়ে তিনি কবিতার ন্যায় পদ্য রচনায়ও অনন্য প্রতিভাধর ছিলেন। কেহ কেহ তাঁর আক্বীদা নিয়ে কিছুটা দ্বিমত পোষণ করলেও উহা যে শুধুই হিংসা-দ্বেষ প্রসূত, তাতে কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ নেই।
খোলাফায়ে রাশেদীনের উপর তাঁর প্রবল আস্থা ও শ্রদ্ধা প্রকাশ এবং তাঁর রচিত গ্রন্থাবলীই তাঁর বিরোধীদের বিদ্বেষী ভাবের সমুচিত জবাব, যাতে আর কোন প্রকার সন্দেহের অবকাশ থাকে না।
চারিত্রিক গুণাবলীঃ হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ) বিরচিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে “তাযকেরাতুল আওলিয়া” নামক গ্রন্থের ভূমিকা রচনার মধ্য দিয়ে লেখকের চারিত্রিক গুণাবলী, বিশেষ করে বিনয়, নম্রতা এবং দৈনতার বাস্তব রূপ ফুটে উঠেছে। তিনি নিজেকে সবচেয়ে দীনহীন এবং ক্ষুদ্র- তম ভাবতেন। একারণেই হয়তো বা আজও তিনি আরিফ এবং আল্লাহ প্রেমিকগণের হৃদয়ে ভাস্বর হয়ে আছেন।
যোগ্যতা, মর্যাদা-তাছনীফাত: মাওলানা নিজামী বলেন, হযরত জালাল উদ্দীন রুমী বলেছেন, শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর উপর দেড় শত বছর পর আল্লাহ পাক স্বীয় নূর অবতীর্ণ এবং ফয়েজ বর্ষণ করেন। বিখ্যাত পারসিক কবি আল্লামা জামী বলেন যে, শেখ ফরিদ উদ্দীনের কাব্যে যে ধরনের অহদানিয়াতের মাহাত্ম্য এবং মা’রেফাতের গহীন রহস্যের সন্ধান মিলে, অপর কোন সূফী কবিরই কবিতায় অনুরূপ পাওয়া যায় না। কেহ কেহ বলেন যে, তাঁর বিরচিত গদ্য ও পদ্যের মোট সংখ্যা পাক কুরআনের সূরার সমান-একশত চৌদ্দটি। মূলতঃ তাঁর বিরচিত গ্রন্থাবলীর সংখ্যা সর্বমোট একশত চৌদ্দখানাই। কাজী নূরুল্লাহ মোশতারী (রহঃ) তাঁর বিরচিত গ্রন্থ “মাজালেসুল মুমিনীনে” এ বিষয়ে একই মত প্রকাশ করেছেন। তবে উক্ত গ্রন্থসমূহের মধ্যে নিম্নোক্ত গ্রন্থাবলী সর্বাধিক উল্লেখযোগ্য।
১। তাজকেরাতুল আওলিয়া
২। মানতিকৃত তায়ির
৩। মুসিবত নামা
৪। আসরার নামা
৫। তাইসির নামা
৬ ইলাহী নামা
৭। গব্দে নামা
৮। অসিয়ত
৯। দিওয়ান
১০। শরহুল কলব
১১। খুশরু গোল
প্রকাশ থাকে যে, হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর বিরচিত গ্রন্থগুলোর আশাতীত জনপ্রিয়তা দেখে অনেক গ্রন্থকার নিজেদের রচিত গ্রন্থসমূহ বেশি পরিমাণে কাটতির নিমিত্ত নিজ নামের স্থলে হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর নাম ব্যবহার করেছেন। এ প্রকার নকল নামের গ্রন্থাবলীর মধ্যে লিসানুল হাকীকতও একখানা, যা লন্ডনস্থ বৃটিশ মিউজিয়ামে সংরক্ষিত রয়েছে।
শাহাদাত বরণ: হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ)-এর শাহাদাত বরণের বিষয়ে জানা যায় যে, যখন তাতারী দস্যুরা নিশাপুরে হামলা করে সেখানে লুণ্ঠন ও হত্যাযজ্ঞ চালায়, তখন তিনি সেথায় অবস্থান করছিলেন।। একজন জালিম তাতারী দস্যু তাকে হত্যা করতে উদ্যত হলে জনৈক ব্যক্তি দেখে দস্যুটাকে বলল যে, এ বুযুর্গ দরবেশকে তুমি হত্যা কর না। হত্যার পরিবর্তে আমি তোমাকে দশ হাজার মোহর দেব। এ ব্যক্তির কথা শ্রবণ করে শেখ ফরিদ উদ্দীন (রহঃ) বলে উঠলেন, আমাকে মাত্র দশ হাজার মোহরের বিনিময়ে বিক্রি কর না। আমার মূল্য যে এরও চেয়ে বহু বেশি। দস্যুটি বেশি অর্থ প্রাপ্তির লোভে তাকে নিয়ে রওয়ানা হল। কিছু দূর অগ্রসর হবার পর আরেক ব্যক্তি তাকে এরূপ বন্দী অবস্থায় দেখে দস্যুটিকে বলল, তাঁকে তুমি হত্যা না করে আমার নিকট দিয়ে দাও। বিনিময়ে আমি তোমাকে একটি খড়ের গোলা প্রদান করবো। এবার শেখ ফরিদ উদ্দীন (রহঃ) বললেন হ্যাঁ, উহা তাকে দিতে পার। তবে আমার মূল্য যে, উহার চেয়েও কম। দস্যুটি তাঁর কথা শ্রবণ করে ভাবল যে, তাঁর সঙ্গে হয়তো সে তামাশা করছেন। এতে দস্যুটি ভীষণ ক্ষুব্ধ হয় এবং সাথে সাথে তাঁর দেহ মোবারককে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলে। বিশ্ব বিখ্যাত সূফী কবি আল্লামা হযরত জালাল উদ্দীন রুমী (রহঃ) নানা সময়ে হযরত শেখ ফরিদ উদ্দীন আত্তার (রহঃ) কে স্বীয় ইমাম ও শ্রেষ্ঠত্ব স্বীকার করে নিজের রচিত বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ মছনবী শরীফে তাঁর প্রতি অশেষ শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করেছেন। তাছাড়া উক্ত গ্রন্থে হযরত রুমী (রহঃ) শেখ ফরিদ উদ্দীন (রহঃ) রচিত একটি কবিতাও সন্নিবেশন করেন।