ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের হুকুম কী? এটি কি আসলেই বিদআত?
- আপডেট সময় : ১২:২৮:৩৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০২৪
- / ২৪২০ বার পড়া হয়েছে
প্রায়শই আমরা শুনে থাকি, ফরজ নামাজের পরে কোনো মুনাজাত নেই। সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করা বিদআত। যারা করেন তারা বিদআতী। বিষয়টি নিয়ে যেহেতু এক শ্রেনির ব্যক্তিবর্গ ফায়দা হাসিলের চেষ্টায় লিপ্ত, তাই এর বিধান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা রাখা আবশ্যক। প্রথমেই বলে রাখা প্রয়োজন, ফরজ নামাযের পর মুনাজাতের বিষয়টি বুঝতে হলে তিনটি পয়েন্ট ভাল করে বুঝতে হবে।
যথা-১. ফরজ নামাযের পর মুনাজাত সহিহ হাদিস দ্বারা প্রমাণিত কি না?
২. সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণিত কি না?
৩. ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের হুকুম কী?
এবার চলুন, একে একে প্রতিটি পয়েন্টের উপর কিছুটা বিস্তারিত আলোচনায় যাওয়া যাক। দেখি, হাদিসের আলোকে এর কোনো প্রামান্য তথ্যাদি পাওয়া যায় কি না।
১ নং ক্রমিকে বর্নিত বিষয়: ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করা একাধিক সহীহ হাদীস দ্বারা ফরজ নামাযের পর মুনাজাত করার বিষয়টি সুপ্রমাণিত। যেমন-
১ নং হাদিস-
وَقَالَ: يَا مُحَمَّدُ، إِذَا صَلَّيْتَ فَقُلْ: اللَّهُمَّ إِنِّي أَسْأَلُكَ فِعْلَ الخَيْرَاتِ، وَتَرْكَ الْمُنْكَرَاتِ، وَحُبَّ الْمَسَاكِينِ،
‘হযরত ইবনে আব্বাস রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। আল্লাহ তাআ’লা বলেন, হে মুহাম্মদ! সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন তুমি নামায পড়ে ফেলবে, তখন এ দুআ করবে- হে আল্লাহ! আপনার নিকট ভাল কাজের তাওফিক চাই এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার ব্যাপারে সাহায্য চাচ্ছি এবং আপনার দরবারের মিসকীন তথা আল্লাহওয়ালাদের মুহাব্বত কামনা করছি।’ {সুনানে তিরমিজী, হাদীস নং-৩২৩৩}
২ নং হাদিস-
ইমাম বুখারী রহমাতুল্লাহি আলাইহি স্বীয় কিতাব আততারীখুল কাবীরে এনেছেন-عَنْ كاتب المغيرة رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ: كَانَ النَّبِيُّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدْعُو في دبر صلاته
হযরত মুগিরা রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষে দুআ করতেন। {আততারীখুল কাবীর, হাদীস নং-১৭৭২, ৬/৮০}
৩ নং হাদিস-
عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ: كَانَ مَقَامِي بَيْنَ كَتِفَيْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَكَانَ إِذَا سَلَّمَ قَالَ: «اللَّهُمَّ اجْعَلْ خَيْرَ عُمُرِي آخِرَهُ، اللَّهُمَّ اجْعَلْ خَوَاتِيمَ عَمَلِي رِضْوَانَكَ، اللَّهُمَّ اجْعَلْ خَيْرَ أَيَّامِى يَوْمَ أَلْقَاكَ»
হযরত আনাস বিন মালিক রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি ছিলাম রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাঁধের পাশে। তখন রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফিরিয়ে বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমার শেষ জীবনকে সবচে’ সুন্দর কর। হে আল্লাহ! তুমি আমার শেষ আমলকে তোমার সন্তুষ্টি অনুপাতে কর। হে আল্লাহ! তুমি তোমার সাথে আমার সাক্ষাতের দিনকে সর্বোত্তম দিন কর। {আলমুজামুল আওসাত লিততাবারানী, হাদীস নং-৯৪১১}
হযরত সাদ রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু বলেন,وَيَقُولُ: إِنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يَتَعَوَّذُ بِهِنَّ فِي دُبُرِ كُلِّ صَلَاةٍ «اللَّهُمَّ إِنِّي أَعُوذُ بِكَ مِنَ الْبُخْلِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنَ الْجُبْنِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ أَنْ أُرَدَّ إِلَى أَرْذَلِ الْعُمُرِ، وَأَعُوذُ بِكَ مِنْ فِتْنَةِ الدُّنْيَا، وَعَذَابِ الْقَبْرِ»
রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতি নামাযের পর এই শব্দে আল্লাহর কাছে পানাহ চাইতেন, “হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে কৃপণতা থেকে পানাহ চাই। এবং অভাব থেকে পানাহ চাই এবং অশীতিপর বৃদ্ধাবস্থা থেকে পানাহ চাই এবং দুনিয়ার ফিতনা ও কবরের আজাব থেকে পানাহ চাই। {সুনানে নাসায়ী, হাদীস নং-৫৪৭৯}
مُحَمَّدُ بْنُ أَبِي يَحْيَى، قَالَ: رَأَيْتُ عَبْدَ اللهِ بْنَ الزُّبَيْرِ وَرَأَى رَجُلًا رَافِعًا يَدَيْهِ بِدَعَوَاتٍ قَبْلَ أَنْ يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ، فَلَمَّا فَرَغَ مِنْهَا، قَالَ: «إِنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ لَمْ يَكُنْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ حَتَّى يَفْرُغَ مِنْ صَلَاتِهِ
হযরত মুহাম্মদ বিন আবী ইয়াহইয়া বলেন, আমি হযরত আব্দুল্লাহ বিন জুবায়ের রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহুকে দেখলাম। তিনি এক ব্যক্তিকে নামাযের ভিতরে হাত তুলে দুআ করছেন। যখন লোকটি নামায শেষ করল। তখন তিনি তাকে বললেন, নিশ্চয় রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামায শেষ করার আগে হাত তুলে দুআ করতেন না। {আলমুজামুল কাবীর লিততাবরানী, হাদীস নং-৩২৪}
এছাড়া আরো অসংখ্য হাদীস রয়েছে যা প্রমাণ করে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামাযের পর হাত তুলে দুআ করতেন।২ নং ক্রমিকে বর্নিত বিষয়: সম্মিলিত মুনাজাত প্রমাণিত কি না?পূর্বের আলোচনা দ্বারা পরিস্কার হয়ে গেল যে, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামায শেষে হাত তুলে দুআ করতেন। এখন প্রশ্ন হল, রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে সম্মিলিতভাবে দুআ করা প্রমাণিত কি না?নিচে কয়েকটি হাদীস দেয়া হল। যা পরিস্কারভাবে সম্মিলিত দুআ করা ও সম্মিলিত দুআর প্রতি উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।
এক. أَنَسَ بْنَ مَالِكٍ، قَالَ: أَتَى رَجُلٌ أَعْرَابِيٌّ مِنْ أَهْلِ البَدْوِ إِلَى رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَوْمَ الجُمُعَةِ، فَقَالَ: يَا رَسُولَ اللَّهِ، هَلَكَتِ المَاشِيَةُ، هَلَكَ العِيَالُ هَلَكَ النَّاسُ، «فَرَفَعَ رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَدَيْهِ، يَدْعُو، وَرَفَعَ النَّاسُ أَيْدِيَهُمْ مَعَهُ يَدْعُونَ
»হযরত আনাস বিন মালিক রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, একদা একজন গ্রাম্য সাহাবী রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে আসলেন জুমআর দিন। এসে বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! জিনিস পত্র, পরিবার, মানুষ সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। একথা শুনে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তার উভয় হাত উত্তলোন করলেন দুআর উদ্দেশ্যে। উপস্থিত সবাই রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সাথে দুআর জন্য হাত উত্তোলন করলেন। {সহীহ বুখারী, হাদীস নং-১০২৯}
এ হাদীসে পরিস্কারভাবে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত প্রমানিত। লক্ষ্য করুন। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দুআ করেছেন, আর উপস্থিত সাহাবীগণ আমীন আমীন বলে সম্মিলিত মুনাজাতে অংশ নিয়েছেন।
দুই. عَنْ حَبِيبِ بْنِ مَسْلَمَةَ الْفِهْرِيِّ – وَكَانَ مُسْتَجَابًا -: أَنَّهُ أُمِّرَ عَلَى جَيْشٍ فَدَرِبَ الدُّرُوبِ، فَلَمَّا لَقِيَ الْعَدُوَّ قَالَ لِلنَّاسِ: سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – يَقُولُ: ” «لَا يَجْتَمِعُ مَلَأٌ فَيَدْعُو بَعْضُهُمْ وَيُؤَمِّنُ سَائِرُهُمْ، إِلَّا أَجَابَهُمُ اللَّهُ» “.ثُمَّ إِنَّهُ حَمِدَ اللَّهَ، وَأَثْنَى عَلَيْهِ، وَقَالَ: اللَّهُمَّ احْقِنْ دِمَاءَنَا، وَاجْعَلْ أُجُورَنَا أُجُورَ الشُّهَدَاءِ،رَوَاهُ الطَّبَرَانِيُّ وَقَالَ: الْهَنْبَاطُ بِالرُّومِيَّةِ: صَاحِبُ الْجَيْشِ. وَرِجَالُهُ رِجَالُ الصَّحِيحِ غَيْرَ ابْنِ لَهِيعَةَ، وَهُوَ حَسَنُ الْحَدِيثِ.
হযরত হাবীব বিন মাসলামা আলফিহরী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু, যিনি মুস্তাজাবুদ দাওয়া ছিলেন। তাকে একবার একটি বাহিনী প্রধান নিযুক্ত করা হয়। যুদ্ধের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি গ্রহণের পর তিনি যখন শত্রুর সম্মুখিন হলেন। তখন লোকদের বললেন, আমি রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে বলতে শুনেছি। তিনি বলেছেন “যখনি কোন দল একত্র হয়, তারপর তাদের কথক দুআ করে, আর অপরদল আমীন বলে তখন আল্লাহ তাআলা তা কবুল করে নেন”।এ হাদীস বলার তিনি [হাবীব বিন মাসলামা রাঃ] হামদ ও সানা পড়লেন। তারপর বললেন, হে আল্লাহ! তুমি আমাদের প্রাণ রক্ষা কর। আর আমাদের শহীদের সওয়াব দান কর।
{মাযমাউজ যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭৩৪৭, মুস্তাতাদরাক আলাস সহীহাইন, হাদীস নং-৫৪৭৮, আলমুজামুল কাবীর, হাদীস নং-৩৫৩৬}
আল্লামা হায়ছামী রহঃ বলেন, উক্ত হাদীসের সূত্রের প্রতিটি রাবী সহীহের রাবী। ইবনে লাহিয়াহ ছাড়া। কিন্তু সেও হাসান পর্যায়ের রাবী।
{মাযমাউয যাওয়ায়েদ-১৭৩৪৭}
তিন. আরো একটি হাদীস উদ্ধৃত করছি। যা আলবিদায়া ওয়াননিহায়া গ্রন্থে আল্লামা ইবনে কাসীর রহঃ সনদসহ বর্ণনা করেছেন।যার সারমর্ম হল, আলা বিন হাযরামী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু মুস্তাজাবুদ দাওয়া সাহাবী ছিলেন। একদা বাহরাইনের জিহাদ থেকে ফেরার পথে এক স্থানে যাত্রাবিরতি করলে খাবার দাবার ও তাবুর রসদসহ উটগুলো পালিয়ে যায়। তখন গভীর রাত। সবাই পেরেশান। ফজরের সময় হয়ে গেলে আজান হল। সবাই নামায আদায় করলেন। নামায শেষে আলা বিন হাযরামী রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু সহ সবাই হাত তুলে সূর্য উদিত হওয়ার সূর্যের কিরণ গায়ে লাগা পর্যন্ত দীর্ঘ সময় দুআ করতে থাকেন।
{আলবিদায়া ওয়াননিহায়া-৬/৩২৮-৩২৯}
উক্ত ঘটনাটির পূর্ণ বিবরণের আরবী পাঠ
وَقَدْ كَانَ الْعَلَاءُ مِنْ سَادَاتِ الصَّحابة الْعُلَمَاءِ العبَّاد مُجَابِي الدَّعوة، اتَّفق لَهُ فِي هَذِهِ الْغَزْوَةِ أنَّه نَزَلَ مَنْزِلًا فَلَمْ يَسْتَقِرَّ النَّاس عَلَى الْأَرْضِ حَتَّى نَفَرَتِ الْإِبِلُ بِمَا عَلَيْهَا مِنْ زَادِ الْجَيْشِ وَخِيَامِهِمْ وشرابهم، وبقوا على الأرض ليس معهم شئ سِوَى ثِيَابِهِمْ – وَذَلِكَ لَيْلًا – وَلَمْ يَقْدِرُوا مِنْهَا عَلَى بَعِيرٍ وَاحِدٍ، فَرَكِبَ النَّاس مِنَ الهمِّ والغمِّ مالا يُحَدُّ وَلَا يُوَصَفُ، وَجَعَلَ بَعْضُهُمْ يُوصِي إِلَى بَعْضٍ، فَنَادَى مُنَادِي الْعَلَاءِ فَاجْتَمَعَ النَّاس إِلَيْهِ، فَقَالَ: أيُّها النَّاس أَلَسْتُمُ الْمُسْلِمِينَ؟ أَلَسْتُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ؟أَلَسْتُمْ أَنْصَارَ اللَّهِ؟ قَالُوا: بَلَى، قَالَ: فَأَبْشِرُوا فَوَاللَّهِ لَا يَخْذِلُ اللَّهُ مَنْ كَانَ فِي مِثْلِ حَالِكُمْ، وَنُودِيَ بِصَلَاةِ الصُّبح حِينَ طَلَعَ الْفَجْرُ فصلَّى بالنَّاس، فلمَّا قَضَى الصَّلاة جَثَا عَلَى رُكْبَتَيْهِ وَجَثَا النَّاس، وَنَصِبَ فِي الدُّعاء وَرَفَعَ يَدَيْهِ وَفَعَلَ النَّاس مِثْلَهُ حَتَّى طَلَعَتِ الشَّمْسُ، وَجَعَلَ النَّاسُ يَنْظُرُونَ إِلَى سَرَابِ الشَّمْسِ يَلْمَعُ مَرَّةً بَعْدَ أُخْرَى وَهُوَ يَجْتَهِدُ فِي الدُّعَاءِচার. عَنْ سَلْمَانَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: قَالَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: «مَا رَفَعَ قَوْمٌ أَكُفَّهُمْ إِلَى اللهِ عَزَّ وَجَلَّ يَسْأَلُونَهُ شَيْئًا، إِلَّا كَانَ حَقًّا عَلَى اللهِ أَنْ يَضَعَ فِي أَيْدِيهِمُ الَّذِي سَأَلُوا
হযরত সালমান রাদিআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত। রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, যখন কোন জামাআত তাদের প্রয়োজন পূর্ণ করার আশায় আল্লাহর দরবারে হাত উঠায়, তখন আল্লাহর উপর হক হল প্রার্থিত বিষয় উক্ত জামাতকে প্রদান করা।
{আলমুজামুল কাবীর লিততাবরানী, হাদীস নং-৬১৪২, আততারগীব ওয়াত তারহীব, হাদীস নং-১৪৪, মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭৩৪১, কানযুল উম্মাল, হাদীস নং-৩১৪৫}
আল্লামা হায়ছামী রহঃ বলেন, এ হাদীসের সনদের সকল রাবীগণ সহীহের রাবী।
{মাযমাউয যাওয়ায়েদ, হাদীস নং-১৭৩৪১}
এরকম আরো অসংখ্য বর্ণনা প্রমাণ করে সম্মলিত মুনাজাত এটি দুআ কবুলের আলামত। সেই সাথে উত্তম আমল। যা কিছুতেই বিদআত হতে পারে না। যে সম্মলিত মুনাজাত রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেছেন সাহাবীদের নিয়ে, সাহাবায়ে কেরাম সাথিবর্গকে নিয়ে যে সম্মলিত মুনাজাত করেছেন, তা কী করে বিদআত হতে পারে?সুতরাং বুঝা গেল যে, সম্মিলিত মুনাজাত করাও রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এবং সাহাবায়ে কেরাম রাঃ থেকে প্রমাণিত। সেই সাথে সম্মিলিতভাবে মুনাজাত করতে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম পরিস্কার ভাষায় উৎসাহ প্রদান করেছেন।৩ নং ক্রমিকে বর্নিত বিষয়: ফরজ নামাযের পর সম্মিলিত মুনাজাতের হুকুম কী?আসলে পূর্বের দু’টি বিষয় পরিস্কার হবার পর আপনি নিজেই এর সমাধান বের করে নিতে পারেন।
নামাযের পর দুআ রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে করেছেন। আর সম্মিলিত দুআ কবুল হয় মর্মে রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন। তিনি নিজেও সম্মিলিতভাবে দুআ করেছেন।সুতরাং ফরজ নামাযের পর দুআ করলে সেটি বিদআত হবে কিভাবে?তবে এক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় লক্ষ্যণীয়। যথা-প্রথমত: ফরজ নামাযের পর দুআকে জরুরী মনে করা। দ্বিতীয়ত: দুআকে নামাযের অংশ মনে করা। তৃতীয়ত: এ ছাড়া নামায পূর্ণ হয় না- এই আকিদা রাখা।
এ তিনটির কোনো একটি পাওয়া গেলে উক্ত দুআ বিদআত হবে। কারণ এর কোনো প্রমাণ নেই।কিন্তু যদি উপরোক্ত কোনো কারণ পাওয়া না যায়। বরং যেহেতু রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফরজ নামাযের পর দুআ করেছেন, সেই সাথে সম্মিলিতভাবে দুআ করতে উৎসাহ প্রদান করেছেন, সেই সওয়াব পাবার আশায় যদি ইমাম সাহেব সম্মিলিতভাবে দুআ করেন, তাহলে উক্ত সম্মিলিত দুআকে বিদআত বলার কোন সুযোগ নেই। যদি কেউ বলে তাহলে সে হাদীসে নববী সম্পর্কে অজ্ঞ ছাড়া আর কিছু নয়।শেষের কথা: অবশ্যপালনীয় আমল মনে না করে ফরজ নামাজের পরে সম্মিলিতভাবে দুআ মুনাজাত করা যাবে। হাদিসে দুআকে ইবাদাত বলা হয়েছে। বরং, ইবাদাতের মগজ বা মূল আখ্যায়িত করা হয়েছে।
সুতরাং, মুনাজাত ও সম্মিলিতভাবে দুআ করার বিষয়ে যারা বিভ্রান্তি ছড়ানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত তাদের গুরুত্ব না দিয়ে আপনি আপনার আমল করতে থাকুন। এরা আল্লাহর কাছে নিজেরা প্রার্থনা করবে না, অন্যদেরও ফিরিয়ে রাখার চেষ্টা করবে। এরা আল্লাহর কাছে সাহায্যের জন্য হাত বাড়াবে না, গর্ব কিংবা অহমে, অন্যরা হাত বাড়িয়ে মুঠি মুঠি রহমত কুড়িয়ে ধন্য হোক তাও চাবে না। তবে, কারও কারও ভেতরে এমন জটিল রোগেরও দেখা মেলে যে, ফরজ নামাজ শেষে সম্মিলিত মুনাজাতে অংশ না নেয়ায় মসজিদ থেকে মুসল্লিদের বের পর্যন্ত করে দেয়া। এই ধরনের জঘন্য কূপমন্ডুকতার স্থান ইসলামে নেই।
উদারতা, মানবতা এবং মানবিকতার যে মহান শিক্ষা ইসলাম তুলে ধরে তার কোথাও এ ধরনের আচরনের দূরতম সম্পর্কও নেই।আল্লাহ পাক আমাদের মূর্খতা দূর করুন। আমাদের আমালে সালেহগুলো কবুল করুন। বেশি বেশি আমালে সালেহ করার তাওফিক দান করুন।
কৈফিয়ত: নিবন্ধের কলেবর বৃদ্ধির আশঙ্কায় আলোচনা সংক্ষিপ্ত করতে হলো। উপস্থাপিত বিষয়ে পরবর্তীতে কোনো পোস্টে আরও বিস্তারিতভাবে লেখার ইচ্ছে থাকলো। আল্লাহ পাক সকলের কল্যান করুন।
ইসলামে মধ্যপন্থা অবলম্বন পছন্দনীয়:
মধ্যপন্থা অবলম্বন করা ইসলামের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য। পবিত্র কুরআন ও হাদিসে অতি উদারতা ও অতি রক্ষণশীলতা পরিহার করে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার প্রতি উৎসাহিত করা হয়েছে। ইসলামের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, অতি উদারতা ও অতি রক্ষণশীলতার কারণে এ উম্মতের ওপর কখনো কখনো বিপর্যয় নেমে এসেছে। এর পেছনে কারণ হিসেবে দেখা যায়, ব্যক্তিবিশেষের ভিন্নমতকে সাধারণ উন্মতের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার অযথা চেষ্টা।
ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করা একটি সুন্নাত আমল। এটিকে বিদ’আত বলার কোনো অবকাশ নেই
উদাহরন হিসেবে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করার মাসআলাটি এখানে প্রনিধানযোগ্য। কিছু লোকের অতি রক্ষণশীলতার কারণে এটি মতানৈক্যপূর্ণ মাসয়ালার রূপ পরিগ্রহ করেছে। একদিকে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করা খুবই প্রয়োজনীয় কাজ মনে করা হচ্ছে, অন্যদিকে এটিকে বিদ’আত ও ঘৃণিত কাজ মনে করা হচ্ছে। অথচ এই দুই অতিরঞ্জিত মতামতের মাঝখানে হলো এ মাসআলার আসল সমাধান। অর্থাৎ ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করা যেমন বাধ্যতামূলক নয়, তেমনি এটি বিদ’আতও নয়। বরং এটি একটি মুসতাহসান বা উত্তম কাজ। কেউ যদি স্বেচ্ছায় করে ভালো, না করলে কোনো জোর-জবরদস্তি নেই। কুরআন-হাদিসের দৃষ্টিতে এটি একটি সুন্নাত আমল। এটিকে বিদ’আত বলার কোনো অবকাশ নেই।
ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করা হাদিসের ছয়টি নির্ভরযোগ্য কিতাব অর্থাৎ সিহাহ সিত্তার মাধ্যমে প্রমাণিত
ফরজ নামাজের পর দোআ করা হাদিসের ছয়টি নির্ভরযোগ্য কিতাব অর্থাৎ সিহাহ সিত্তার মাধ্যমে প্রমাণিত। অন্যদিকে দোআর সময় হাত তোলার কথাও হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। কিন্তু এমন কোনো প্রমাণ নেই, যাতে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করাকে হারাম কিংবা নিষেধ করা হয়েছে। সাহাবায়ে কেরামের জামানা থেকে আজ পর্যন্ত হাজার বছর ধরে ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোআ করার নিয়ম চলে আসছে। এতে কেউ আপত্তি করেনি। ইমাম আবু হানিফা রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম মালেক রহমাতুল্লাহি আলাইহি, ইমাম শাফেয়ি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এবং ইমাম আহমাদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর মতো অগণিত ফকিহ ও মুহাদ্দিস চলে গেছেন। কোনো একজন ইমামও এ বিষয়ে আপত্তি করেননি। শুধু ইবনে তাইমিয়া রহমাতুল্লাহি আলাইহি ও ইবনে কাইয়্যিম রহমাতুল্লাহি আলাইহি আপত্তি জানিয়েছেন। আহলে হাদিসের আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানীর অনুকরণে বর্তমানে কিছু লা-মাজহাবি আলেম ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত সম্পর্কে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করেছেন, যা শরিয়তের যুক্তিতে কখনো গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হ্যাঁ, যাঁরা ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাত করাকে বাধ্যতামূলক মনে করতেন, তাঁরাও ভুলের মধ্যে আছেন। জায়েজ কাজকে বাধ্যতামূলক মনে করাও শরিয়তের দৃষ্টিতে গর্হিত কাজ। এতে সন্দেহ নেই।
আরবেও হাত তুলে মোনাজাত চালু ছিল:
আরব রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল ওয়াহহাব নাজদির উত্থানের আগ পর্যন্ত এবং পেট্রো ডলার পাওয়ার আগ পর্যন্ত ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মোনাজাতের আমল জারি ছিল। এমনকি লা-মাজহাবিদের বড় বড় আলেমও তা সমর্থন করেছেন। যেমন সায়্যিদ নাজির হোসাইন, নাওয়াব সিদ্দিক হাসান (ভূপালি), সানাউল্লাহ, হাফেজ আব্দুল্লাহ, মাওলানা মুবারকপুরীর মতো বড় বড় আলেম নামাজের পর হাত তুলে দোআ করাকে বিদ’আত বলেননি। কয়েকজন লোকের ভিন্ন মতের কারণে উম্মতের কাছে গ্রহণযোগ্য একটি আমলকে বিদ’আত বলা কখনো যুক্তিসংগত হতে পারে না।
রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ২২টি জায়গায় দোআ করার হাদিস রয়েছে। এর মধ্যে ফরজ নামাজের পর অন্যতম।
হাদিসের কিতাব অধ্যয়নে দেখা যায়, দোআর জন্য নির্দিষ্ট কোনো দিন বা সময়ের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে ২২টি জায়গায় দোআ করার হাদিস রয়েছে। এর মধ্যে ফরজ নামাজের পর অন্যতম। এ মাসআলাটি সকলের নিকট বোধগম্য করে উপস্থাপন করতে অল্পবিস্তর আলোচনার প্রয়োজন। আমরা এ নিবন্ধে হাদিস, সলফে সালেহিনের আমল ও তাঁদের বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
হাদিসের ভান্ডার থেকে কিছু হাদিস-
১. রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘তোমাদের প্রতিপালক অবশ্যই লজ্জাশীল এবং সম্মানী। বান্দা যখন তাঁর কাছে দুই হাত তুলে দোআ করে, তখন তিনি খালি হাত ফেরত দিতে লজ্জাবোধ করেন।’ ইমাম হাকেম হাদিসটিকে সহিহ বলেছেন। লা-মাজহাবিদের আলেম আল্লামা সফিউর রহমান মোবারকপুরী এই হাদিসের ব্যাখ্যায় এটিকে সহিহ বলে মেনে নিয়েছেন। অন্যদিকে ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই হাদিসটি বর্ণনা করে কোনো মন্তব্য করেননি। এতে বোঝা গেল, হাদিসটি নিঃসন্দেহে সহিহ।
লা-মাজহাবিদের আলেম নাসিরুদ্দীন আলবানী সহিহ ইবনে মাজাহ ও জয়িফ ইবনে মাজাহ নামে দুটি কিতাব লিখেছেন। এতে এই হাদিসটি সহিহ ইবনে মাজাহয় অন্তর্ভুক্ত করেছেন।
লা-মাজহাবিদের আলেম মাওলানা উবাইদুল্লাহ মোবারকপুরী মিশকাত শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থে এ হাদিসটিকে সহিহ বলে উল্লেখ করেছেন। এতে বোঝা যায়, হাদিসটি সবার কাছে সহিহ এবং নির্ভরযোগ্য।
এ হাদিসে সুস্পষ্টভাবে দোআর সময় হাত তোলার কথা উল্লেখ রয়েছে, যা কোনো বিশেষ দোআ কিংবা বিশেষ কার্যকারনের সাথে নির্দিষ্ট বা সম্পৃক্ত নয়। বরং সর্বক্ষেত্রে এটি প্রযোজ্য বিধায় ফরজ নামাজের পর দোআতেও এটি প্রযোজ্য।
হজরত ইমাম তিরমিজি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে একটি অধ্যায় লিখেছেন এভাবে- ‘দোয়ার সময় হাত তোলা সম্পর্কীয় হাদিসগুলোর বর্ণনা।’ তিনি এ বিষয়টিকে অধ্যায় নির্ধারণ করাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, দোয়ার সময় হাত তোলা ইমাম তিরমিজি রহমাতুল্লাহি আলাইহি -এর কাছে হাদিস দ্বারা প্রমাণিত। এতে তিনি একটি হাদিস উল্লেখ করেন-
২. হজরত উমর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়ার সময় হাত উঠালে তা নামানোর আগে চেহারা মোবারকে মুছে নিতেন (জামেয়ে তিরমিজি ২/১৭৬, আল মুজামুল আওসাত লিত্তাবরানি ৫/১৯৭, হাদিস: ৭০৫৩)।
এই হাদিস সম্পর্কে ইমাম তিরমিজি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেছেন, হাদিসটি সহিহ। বিশিষ্ট হাদিস বিশারদ আল্লামা হাফেজ ইবনে হাজর আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি বলেন, হাদিসটি হাসান।
হজরত উমর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু সূত্রে বর্ণিত, এ হাদিসের মধ্যে স্পষ্টভাবে দোয়ার সময় হাত তোলার কথা উল্লেখ আছে। এতে বোঝা যায়, দোয়ার সময় হাত তোলা নবীজি সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সুন্নাত এবং দোয়ার শেষে হাত দিয়ে মুখমণ্ডল মাসেহ করাও সুন্নাত।
৩. হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেন, তোমরা আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করার সময় হাতের তালু ওপর দিকে করো। হাতের তালুর উল্টো দিক করে প্রার্থনা করো না। যখন দোয়া করা শেষ হবে, দুই হাত দিয়ে মুখমণ্ডল মাসেহ করো (আবু দাউদ ৫৫৩, আদ্দাওয়াতুল কবির লিল বায়হাকি, পৃ. ৩৯)।
৪. ইমাম ইবনে মাজাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি বর্ণনা করেছেন এভাবে- হজরত ইবনে আব্বাস কর্তৃক বর্ণিত আবু দাউদ শরিফের উল্লিখিত হাদিস সম্পর্কে লা-মাজহাবি কোনো কোনো আলেম প্রশ্ন তুলেছেন যে ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি এই হাদিসের সনদে একজন বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করেননি। সেজন্য হাদিসটি জয়িফ। এ প্রশ্নের উত্তরে লা-মাজহাবদেরই আলেম মাওলানা শামসুল হক আজিমবাদী আবু দাউদ শরিফের ব্যাখ্যা গ্রন্থ আইনুল মাবুদে ওই হাদিসের ব্যাখ্যা করেছেন, ইমাম আবু দাউদ রহমাতুল্লাহি আলাইহি যে বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করেননি, সে বর্ণনাকারীর নাম ইমাম ইবনে মাজাহ রহমাতুল্লাহি আলাইহি ইবনে মাজাহ শরিফে উল্লেখ করেছেন। হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহিও তাঁর কিতাব তাকরিবুত তাহজিবে ওই বর্ণনাকারীর নাম উল্লেখ করেছেন। ফলে হাদিসটি জয়িফ বলার কোনো অবকাশ থাকে না।
লা-মাজহাবিদের কোনো আলেমের কথা অনুযায়ী যদি ওই হাদিসটির সনদ জয়িফও ধরে নেওয়া যায়, তখনো আলোচ্য বিষয়ে হাদিসটি দলিল হওয়ার সম্পূর্ণ উপযোগী। কারণ লা-মাজহাবিদের আলেম হাফেজ আব্দুল্লাহ রওপুরী তাঁর একটি ফতোয়ায় লিখেছেন, ‘শরিয়তের বিধান দুই প্রকার। এক. কোনো কিছুকে বৈধ স্বীকৃতি দেওয়া, দুই. অবৈধ বলে স্বীকৃতি দেওয়া।’ প্রথম প্রকারের বিধানের জন্য সহিহ ও জয়িফ হাদিস দুটিই প্রযোজ্য। দ্বিতীয় প্রকারের জন্য শুধু সহিহ হাদিসই প্রযোজ্য।
ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা প্রথম প্রকারের অন্তর্ভুক্ত, অর্থাৎ এটি একটি জায়েজ কাজ, হারাম কাজ নয়। তাই মাসয়ালাটি প্রমাণিত হওয়ার জন্য সহিহ ও জয়িফ উভয় প্রকারের হাদিসই প্রযোজ্য। এ ছাড়া তিনি এও মেনে নিয়েছেন, ফরজ নামাজের পর হাত তুলে মুনাজাত করা মুস্তাহাব আমল (ফাতাওয়া উলামায়ে আহলে হাদিস ১/২২-১৯৮৭ ইং)।
৫. রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নিয়ম ছিল, ‘তিনি যখন হাত উঠিয়ে দোয়া করতেন, তখন নিজের হাত চেহারা মোবারকে ফেরাতেন’ (আবু দাউদ) (হাদিসটি মুহাদ্দিসিনের কাছে গ্রহণযোগ্য)।
৬. মুহাম্মদ ইবনে আবি ইয়াহইয়া বলেন, হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু এক ব্যক্তিকে নামাজ থেকে ফারেগ হওয়ার আগে হাত তুলে দোয়া করতে দেখেন। ওই ব্যক্তি নামাজ শেষ করার পর হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে জুবাইর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু তাঁকে বলেন, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ শেষ করার আগে দোয়ার জন্য হাত ওঠাতেন না (মাজমাউজ যাওয়ায়েদ)।
এ হাদিসটি হাফেজ ইবনে হায়সাম তাবারানির হাওয়ালায় বর্ণনা করেছেন। বর্ণনাকারীদের ব্যাপারে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, ‘ওয়া রিজালুহুস সেকাত’-এর সব বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য।
৭. মুসান্নাফে ইবনে আবি শায়বার এ হাদিসে ফরজ নামাজের পর হাত উঠিয়ে দোয়া করার ব্যাপারে স্পষ্ট বক্তব্য রয়েছে।
আসওয়াদ আমেরি তাঁর বাবার সূত্রে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সঙ্গে ফজরের নামাজ আদায় করেছি। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাম ফেরানোর পর পাশ ফেরালেন এবং হাত তুলে দোয়া করলেন (এলাউস সুনান ৩/১৬৪, ফাতাওয়ায়ে নজিরিয়া ২৪৫, ২৬৫, ৩৫২)।
৮. হজরত ফজল ইবনে আব্বাস রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু -এর এই বর্ণনাটি বিভিন্ন হাদিসের কিতাবে বর্ণিত হয়েছে, যা থেকে হাত উঠিয়ে দোয়া করা মুস্তাহাব প্রমাণিত হয়।
এ হাদিসে প্রমাণিত হয়, নামাজ একাগ্রতা বা খুশুখুজুর সঙ্গে পড়া এবং এরপর দুই হাত তুলে হাতের তালু চেহারার সামনে রেখে দোয়া করা (তিরমিজি, নাসায়ি)।
মুহাদ্দিসিন ও ফকিহদের দীর্ঘ যাচাই ও আলোচনার পর হাদিসটি নির্ভরযোগ্য বলেই বিবেচিত হয়েছে।
৯. হজরত আনাস ইবনে মালেক রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু সূত্রে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেন- যে ব্যক্তি নামাজের পর হাত বিস্তৃত করে এই দোয়া করবে- ‘হে আল্লাহ! যিনি আমার এবং ইবরাহিম, ইসহাক, ইয়াকুব আলাইহিস সালাম -এর খোদা, জিবরাইল, মিকাইল, ইসরাফিল আলাইহিস সালাম -এরও খোদা, আপনার কাছে প্রার্থনা করছি, আমার দোয়া কবুল করুন। কারণ আমি মুখাপেক্ষী, পেরেশান এবং অপারগ। আমাকে দ্বীনের সঙ্গে হেফাজত করুন, গুনাহ থেকে বাঁচান, অভাব দূর করে দিন। তখন আল্লাহ তায়ালা তাঁর দুই হাতকে খালি ফেরাবেন না (আমলুল ইয়াওমি ওয়াল্লায়লাতি ৪৮, ৪৯, কানজুল উম্মাল ২/৮৪)। এ হাদিসের দুজন বর্ণনাকারী সম্পর্কে কিছু কথা থাকলেও ইবনে মুইন বলেছেন, হাদিসটি প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করায় কোনো সমস্যা নেই। একই মন্তব্য করেছেন ইয়াকুব ইবনে সুফিয়ান। সুতরাং হাদিসটি নির্ভরযোগ্য।
১০. ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি তাঁর কিতাব আদ্দাওয়াতে ‘বাবু রাফয়িল ইয়াদায়ি ফিদ দোয়া’য় হজরত আবু মুসা আশআরি রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু সূত্রে বর্ণনা করেন- রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করেছেন, দোয়ার মধ্যে উভয় হাত এটুকু উঠিয়েছেন, যাতে তাঁর হাতের পাতার শুভ্রভাগ দেখা গিয়েছে।
এ ছাড়া ইমাম বুখারি রহমাতুল্লাহি আলাইহি এ অধ্যায়ে হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু, হজরত আনাস রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু সূত্রে বর্ণিত দুটি হাদিস উল্লেখ করেছেন। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখ আছে- এ তিনটি হাদিসের আলোকে বুখারি শরিফের ব্যাখ্যাকার হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি লেখেন, প্রথম হাদিসটি তাঁদের জবাব, যাঁরা বলেন হাত তুলে দোয়া করা শুধু ইসতিস্কার নামাজের জন্যই খাস। দ্বিতীয় হাদিসদ্বয় তাঁদের জবাব, যারা বলেন, ইসতিস্কার দোয়া ছাড়া অন্য কোনো দোয়ায় হাত উঠানো যাবে না (ফতহুল বারি ১১/১১৯)।
এ মাসয়ালার সমর্থনে হজরত ইবনে হাজার রহমাতুল্লাহি আলাইহি আল আদাবুল মুফরাদ, বুখারি, মুসলিম, তিরমিজি, নাসায়ি ও হাকেমের উদ্ধৃতি দিয়ে আরো কিছু বর্ণনা উল্লেখ করেছেন। তা থেকে কয়েকটি হাদিস এখানে উল্লেখ করছি।
১১. ‘এরপর তিনি উল্লেখ করেন, এক ব্যক্তি দীর্ঘ সফর করে এবং খুব পেরেশান ও মলিন বদনে আসমানের দিকে হাত তুলে দোয়া করেন, হে আল্লাহ!… তখন সে ব্যক্তির দোয়া কবুল করা হয় (রাফউল ইয়াদাইন ১৮, সহিহ মুসলিম কিতাবুদ দোয়া)।
১২. রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম দোয়া করার সময় বুক পর্যন্ত হাত তুলতেন এবং দোয়া শেষে হাত মোবারক চেহারায় ফেরাতেন (মুসান্নাফে আব্দুর রাজ্জাক ২/২৪৭)।
১৩. ‘নামাজ শেষ করার পর রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজের ডান হাত কপালের ওপর ফেরাতেন… (ইবনে সানি ৩৯)।
সিহাহ সিত্তার অনেক হাদিস থেকে এ কথা তো দিবালোকের মতো পরিষ্কার যে রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিভিন্ন ক্ষেত্রে দোয়ার সময় হাত উঠিয়েছেন এবং হাত মুখে ফিরিয়েছেন।
নামাজের পরে হাত তুলে দোয়া করার আরো কিছু প্রমানাদি:
ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি মুহাজজাবের ব্যাখ্যা গ্রন্থ ‘আল মাজমু’ গ্রন্থে দোয়ার মধ্যে হাত উঠানো এবং হাতের তালু মুখে ফেরানোর ব্যাপারে ৩০ টি হাদিস উল্লেখ করেছেন। এরপর তিনি এর বিধান সম্পর্কে মন্তব্য করেন, দোয়ায় হাত উঠানো মুস্তাহাব (আল মাজমু ৪৪৮-৪৫০)।
সব শেষে ইমাম নববী রহমাতুল্লাহি আলাইহি লেখেন, যারা এসব হাদিসকে কোনো সময় বা স্থানের সঙ্গে নির্দিষ্ট করে, তারা বড়ই ভ্রান্তির মধ্যে আছে।
তিনি কিতাবুল আজকারে নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করার বিষয়টি জায়েজ বলে উল্লেখ করেছেন। এবং এর প্রমাণে তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হজরত উমর রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু -এর বর্ণনা এবং আবু দাউদ শরিফে বর্ণিত হজরত ইবনে আব্বাস রাদিঅআল্লাহু তাআ’লা আনহু -এর হাদিস উল্লেখ করেছেন (কিতাবুল আজকার ২৩৫)।
বিষয়টি নিয়ে হজরত ইবনে হাজার আসকালানি রহমাতুল্লাহি আলাইহি ফতহুল বারি ১১/১১৮ এবং বুলুগুল মুরামে সবিস্তার আলোচনা করেছেন। সেখানে তিনি বিভিন্ন হাদিস উল্লেখ করে দোয়ায় হাত উঠানো মুস্তাহাব প্রমাণ করেছেন। এই দীর্ঘ আলোচনা থেকে স্পষ্ট প্রমাণ হলো, হাত তুলে দোয়া করা মুস্তাহাব এবং নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করাও উত্তম কাজ।
ভদ্র সালাফিগন সত্যকে ঠিকই স্বীকার করে নেন:
বর্তমানে লা-মাজহাবি যারা নামাজের পর দোয়া করাকে সরাসরি বিদ’আত বলে হক্কানি উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে বিষোদগার করছেন, তাঁদের বিজ্ঞজনদের এ ব্যাপারে মতামত কী, দেখা যাক।
তাদের নির্ভরযোগ্য কিতাব নজলুল আবরার। তাতে স্পষ্ট লেখা আছে- ‘দোয়াকারী দোয়ার সময় হাত উঠাবে। কাঁধ পর্যন্ত হাত তুলবে। এটি দোয়ার আদব। কারণ এটি রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্বীকৃত।’
এরপর লেখেন, ‘যে দোয়াই হোক, যখনই হোক, চাই তা পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের পরে হোক বা অন্য সময়, তাতে হাত তুলে দোয়া করা উত্তম আদব। হাদিসের মর্মবাণী এর প্রমাণ বহন করে। মূলত নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করার বিষয়টি নিতান্তই স্বাভাবিক এবং সবার জানা হওয়ায় সে ব্যাপারে ভিন্নভাবে স্পষ্ট বর্ণনা পাওয়া যায় না’ (নাজলুল আবরার ৩৬)।
মাওলানা আব্দুর রহমান মোবারকপুরী তুহফাতুল আহওয়াজিতে লেখেন, ‘নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করা জায়েজ।’ (তুহফাতুল আহওয়াজি ২/২০২, ১/২৪৪)।
জামেয়া সালাফিয়া বেনারস থেকে প্রকাশিত ‘আলমুহাদ্দিস’ জুন ১৯৮২ সালে মাওলানা উবাইদুল্লাহ মোবারকপুরী একটি ইস্তিফতার জবাবে লেখেন- ‘ফরজ নামাজের পর হাত তুলে দোয়া করাও রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে স্বীকৃত বিষয়।’
তিনি আরো লেখেন, ‘আমাদের মতে ফরজ নামাজের সালাম ফেরানোর পর বাধ্যবাধকতা ছাড়া ইমাম ও মুক্তাদি হাত উঠিয়ে অনুচ্চস্বরে দোয়া করা জায়েজ। এটি একাকী হোক বা সামষ্টিকভাবে হোক, আমাদের আমলও এটি’ (মুহাদ্দিস, জুন ১৯৮২)।
শেষের কথা:
আমাদের কর্তব্য হচ্ছে, দোয়াকে শুধু হাত তোলার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা উচিত নয়। আবার এমনও নয় যে দোয়ায় হাত তোলা বিদ’আত। রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজের পর দোয়ায় হাত তুলেছেন। কিন্তু কম তুলেছেন। কারণ রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এমন জিকিরই সব সময় করতেন, যা তাঁর জন্য আল্লাহর পক্ষ থেকে নির্ধারিত ছিল। বাকি বিষয় তিনি উম্মতের উৎসাহের জন্য করেছেন। কাজেই কেউ যদি নামাজের পর নিয়মিত দুই হাত তুলে দোয়া করেন, তবে তিনি রাসুলের উৎসাহের ওপর আমল করছেন। আল্লাহ পাক আমাদের সহিহভাবে দ্বীন বুঝে সহিহ আমল করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
নিবন্ধটি তৈরিতে সহযোগিতা নেয়া হয়েছে যেসব সূত্র থেকে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা:
আলবিদায়া ওয়াননিহায়া
আহলে হক মিডিয়া।
মাযমাউয যাওয়ায়েদ।
বুখারি শরিফ।
মুসলিম শরিফ।
তিরমিযি শরিফ।
নাসায়ি শরিফ।
মুস্তাতাদরাক আলাস সহীহাইন।
আলমুজামুল কাবীর।
আলমুজামুল কাবীর লিততাবরানী।
আততারগীব ওয়াত তারহীব।
কানযুল উম্মাল।
আলমুজামুল আওসাত লিততাবারানী।
আততারীখুল কাবীর।